১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন প্রণয়নের পটভূমি কী ছিল? এই আইনের ত্রূটিবিচ্যুতি গুলি উল্লেখ করাে।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের পটভূমি

[1] জাতীয়তাবাদের প্রসার: ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অগ্রগতিতে ব্রিটিশ সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। সরকার এই জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার উপায় খুঁজতে থাকে। তারা মনে করে যে, নতুন কোনাে সংস্কার আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা সম্ভব।


[2] আন্দোলনের তীব্রতা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। ফলে বিভিন্ন দল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন (১৯২০-২২ খ্রি.), আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-৩৪ খ্রি.) সহ বিভিন্ন আন্দোলন অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে।


[3] বিপ্লবী কার্যকলাপ: ১৯৩০-এর দশকে দেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ভগত সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, রাজগুরু, বসন্ত বিশ্বাস, বাঘা যতীন-সহ বিভিন্ন বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।


[4] সাইমন কমিশনের প্রতিক্রিয়া: ভারতীয়রা স্বায়ত্তশাসন লাভের উপযুক্ত কিনা তা বিচার করতে সাইমন কমিশন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই কমিশনের রিপাের্টে শাসন পরিচালনা, আইন রচনা প্রভৃতি বিষয়ে ভারতীয়দের যােগ্যতা নিয়ে খুবই অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়। এতে ভারতীয়রা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।


[5] গােলটেবিল বৈঠক: সাইমন কমিশনের রিপাের্টের ভিত্তিতে সরকার প্রথম গােলটেবিল (১৯৩০ খ্রি.), দ্বিতীয় গােলটেবিল (১৯৩১ খ্রি.) ও তৃতীয় গােলটেবিল (১৯৩২ খ্রি.) বৈঠকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতে সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলােচনা চালায়।


[6] শ্বেতপত্র: সাইমন কমিশনের রিপাের্ট ও তিনটি গােলটেবিল বৈঠকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর সরকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবসমূহ শিরােনামে একটি 'শ্বেতপত্র' (White Paper) প্রকাশ করে। এসব প্রস্তাব এবং যৌথ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন (Govt. of India Act, 1935) পাস করে।


১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের ত্রূটিবিচ্যুতি


[1] স্বায়ত্তশাসন বঞ্চনা: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতীয়দের হাতে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। কেন্দ্রে গভর্নর-জেনারেল ও প্রদেশগুলিতে গভর্নরদের সীমাহীন ক্ষমতা স্বায়ত্তশাসনকে প্রহসনে পরিণত করে। ড. বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, "এই নতুন ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) ভারতের জাতীয়তাবাদী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।"


[2] যুক্তরাষ্ট্রে যােগদান: এই আইনে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও তাতে দেশীয় রাজ্যগুলির যােগদান দেশীয় রাজন্যবর্গের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হওয়ার আশঙ্কায় মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্র গঠনের বিরােধী ছিল।


[3] যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে ক্ষতিগ্রস্ত: এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রের গভর্নর-জেনারেলের আধিপত্য এবং বিভিন্ন প্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গভর্নর-জেনারেলের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাই আইনে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলে বাস্তবে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। ফলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত বলেছেন যে, "প্রস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ছিল একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত নামকরণ।"


[4] নামমাত্র ভােটাধিকার প্রদান: এই আইনের দ্বারা ভােটাধিকারের সম্প্রসারণের কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ব্রিটিশ ভারতের মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ ভােটদানের অধিকার পায়। এই ফলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়।


[5] সাম্প্রদায়িক নির্বাচন: এই আইনে মুসলিমদের জন্য সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্যও সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের কথা বলা হয়।