১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

সূচনা: ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-বিষয়ক যে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করে তা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত। সরকার ঘােষণা করে যে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে এই আইন কার্যকরী হবে।


১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্য

এই আইনের বিভিন্ন শর্তগুলিকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা- [1] কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়ক শর্ত, [2] প্রাদেশিক সরকার বিষয়ক শর্ত।


[1] কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়ক শর্ত


  • যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে দুই ধরনের রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল- [a] ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল। [b] দেশীয় শাকদের দ্বারা শাসিত বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতের প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীন রাজ্য ও বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের ইচ্ছানুসারে এই যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দিতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হয় বড়ােলাট ও তার অধীনস্থ একটি মন্ত্রীসভার হাতে।


  • কেন্দ্র ও প্রদেশের তালিকা: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের উদ্দেশ্যে তিনটি তালিকা তৈরি করা হয়, যথা-


    • কেন্দ্রীয় তালিকা: কেন্দ্রীয় তালিকায় রাখা হয় সামরিক বিভাগ, বিদেশনীতি, রেল, ডাক, মুদ্রা প্রভৃতি।

    • প্রাদেশিক তালিকা: প্রাদেশিক তালিকায় রাখা হয় শান্তিশৃঙ্খলা, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পুলিশ প্রভৃতি।

    • যুগ্ম তালিকা: যুগ্ম তালিকায় রাখা হয় সংবাদপত্র, মুদ্রণ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি।


  • দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: কেন্দ্র পাঁচ বছর মেয়াদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বলা হয়, আইনসভার উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেটস-এর ২৬০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫৬ জন ব্রিটিশ ভারত থেকে নির্বাচিত ও ১০৪ জন দেশীয় রাজ্যগুলির রাজাদের দ্বারা মনােনীত হবেন এবং নিম্নকক্ষ ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ৩৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ২৫০ জন ব্রিটিশ ভারত থেকে নির্বাচিত ও ১২৫ জন দেশীয় রাজ্যগুলির রাজাদের দ্বারা মনােনীত হবেন।


  • বড়ােলাটের ক্ষমতা: বড়ােলাট কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা পান। তাঁর হাতে আইনসভা আহ্বান ও বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আইনসভার উভয় কক্ষের দ্বারা অনুমােদিত কোনাে বিলও তার সম্মতি ছাড়া আইনে পরিণত হত না। অর্ডিন্যান্স জারি করে তিনি আইন তৈরি করতে পারতেন। তিনি আইনসভা ও মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ উপেক্ষা করার এবং তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার পান। এ ছাড়া তাঁর হাতে কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ও স্ববিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা ছিল। তিনি তাঁর কাজের জন্য সরাসরি ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।


  • মন্ত্রীসভা: কেন্দ্রে বড়ােলাটের অধীনস্থ একটি মন্ত্রীসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বলা হয় যে, বড়ােলাট আইনসভার সদস্যদের থেকে মন্ত্রীদের নিয়ােগ করবেন এবং মন্ত্রীরা তাদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকবে।


  • সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত বিষয়


    • সংরক্ষিত বিষয়: সংরক্ষিত বিষয়ের মধ্যে ছিল প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি, রিজার্ভ ব্যাংক, সেনাবাহিনী, রেল, অর্থ, মুদ্রা, শান্তি- শৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি সংরক্ষিত' (Reserve) বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা ছিল বড়লাটের হাতে।


    • হস্তান্তরিত বিষয়: হস্তান্তরিত বিষয়ের মধ্যে ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ প্রভৃতি। 'হস্তান্তরিত বিষয়গুলি গভর্নর- জেনারেল তার মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে পরিচালনার দায়িত্ব পান। এভাবে কেন্দ্রে এক ধরনের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা (Dyarchy) প্রতিষ্ঠিত হয়।


  • সাম্প্রদায়িক নির্বাচন: মুসলিম সদস্যদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং তপশিলি সদস্যদের পুনা চুক্তি (১৯৩২ খ্রি.)র ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। শিখ, খ্রিস্টান, ইঙ্গ ভারতীয়, ইউরােপীয় প্রভৃতি প্রতিনিধিদেরও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আইনসভায় গ্রহণ করা হয়।


[2] প্রাদেশিক সরকার বিষয়ক শর্ত


  • আইনসভা: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রাদেশিক আইনসভা একক বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট উভয়ই হতে পারত। বাংলা-সহ ছয়টি প্রদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অবশিষ্ট পাঁচটি প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়।


  • স্বায়ত্তশাসন: এই আইনের দ্বারা প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। ফলে প্রদেশগুলিতে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটে।


  • মন্ত্রীসভা: প্রতিটি প্রাদেশিক গভর্নরের শাসনকার্যে সহায়তার জন্য তার অধীনে একটি করে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। মন্ত্রীরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্য থেকে মনােনীত হতেন এবং তাদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন।


  • গভর্নরের ক্ষমতা: কেন্দ্রের অনুকরণে প্রদেশগুলির শাসনকাঠানাে গড়ে তােলা হয়। গভর্নর প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব পান। আইনসভার যে-কোনাে প্রস্তাব বাতিল করা, অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করা, আইনসভা ও মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে নিজের হাতে প্রদেশেরশাসনক্ষমতা গ্রহণ করা প্রভৃতি বিশেষ ক্ষমতা গভর্নরের হাতে দেওয়া হয়।


  • সাম্প্রদায়িক নির্বাচন: প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতেও কেন্দ্রের অনুকরণে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। তপশিলি সম্প্রদায়ের জন্য 'পুনা চুক্তি' (১৯৩২ খ্রি.) অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।


উপসংহার: এই আইনের দ্বারা ভারতে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন চালু হওয়া, ভােটাধিকার সংকুচিত করা প্রভৃতি ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আইনটি ভারতীয়রা সাদরে গ্রহণ করেনি। এই আইনকে কংগ্রেস 'সম্পূর্ণ হতাশজনক' এবং মুসমিল লিগ 'গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধ্বংসকারী’ বলে অভিহিত করে।


১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের বিভিন্ন শর্তগুলি উল্লেখ করাে।


১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এর পটভূমি ব্যাখ্যা করাে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এর মূল ত্রূটিগুলি কী ছিল?


মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের (১৯১৯) বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।