কোম্পানির আমলে ভারতীয় বাণিজ্যের প্রকৃতিতে কী পরিবর্তন ঘটে?

সূচনা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ভারতে আসে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ ও তার পরবর্তীকালে ভারতে কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রসার ঘটে। ফলে এদেশে কোম্পানির বাণিজ্যিক সুযােগসুবিধা আরও বৃদ্ধি পায়।


কোম্পানির আমলে ভারতীয় বাণিজ্য পরিবর্তন

[1] বাণিজ্যিক সনদ লাভ: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর) ইংল্যান্ডের মহারানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য প্রাচ্যদেশে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায়। ইংরেজ কোম্পানি ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সুরাটে তাদের প্রথম বাণিজ্যিক কুঠি প্রতিষ্ঠা করে। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর দূত স্যার টমাস রাে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে মােগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে হাজির হয়ে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা প্রার্থনা করেন। ইংরেজরা ভারতের বিভিন্ন অংশে বাণিজ্যের অধিকার পায়। পরবর্তীকালে ভারতের আগ্রা, আহম্মদনগর, ব্রোচ, মাদ্রাজ, কলকাতা-সহ বিভিন্ন স্থানেও বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে।


[2] দস্তক লাভ: কোম্পানির দূত জন স্যারম্যান এদেশে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে মােগল সম্রাট ফারুখশিয়ারের কাছে উপস্থিত হন। কোম্পানি ফারুখশিয়ারের কাছ থেকে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমান বা দস্তক' লাভ করে। এর দ্বারা কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার পায়।


[3] দস্তকের অপব্যবহার: ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের ফরমানে কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়, এটি কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জন্য দেওয়া হয়নি। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে এই দস্তক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে থাকে। দস্তকের অপব্যবহারের ফলে নবাব তার প্রাপ্য বিপুল পরিমাণ শুল্ক থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে নবাবকে শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করার ফলে দেশীয় বণিকরা প্রতিযােগিতায় পিছু হঠতে থাকে। মিরকাশিম দস্তকের অপব্যবহার রােধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।


[4] একচেটিয়া বাণিজ্য: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে এবং বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়। তারা বাংলার বাণিজ্য থেকে অন্যান্য ইউরােপীয় বণিকদের সরিয়ে এখানে একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে লবণ, সুপারি ও তামাকের ব্যাবসায় কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহাল থাকে।


[5] ব্যক্তিগত বাণিজ্য: কোম্পানির কর্মচারীরা এদেশে নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। তারা ব্যক্তিগত বাণিজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতেন এবং অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন। বাংলার গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ও তাঁর কাউন্সিলের সদস্যরা ব্যক্তিগত ব্যাবসায় যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছিলেন।


[6] বাংলার রাজস্ব ব্যবহার: পলাশির যুদ্ধজয়ের দ্বারা বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার পর থেকে কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে মূলধন আমদানি না করে বাংলা থেকে আদায় করা রাজস্বের একটি অংশ এদেশ থেকে মালপত্র কেনার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে যায়। এ ছাড়াও কোম্পানি চিন থেকে সবুজ চা ও রেশম কিনে ইউরােপে রপ্তানি করত।


[7] পণ্য ক্রয় পদ্ধতি: কোম্পানি ১৭০০ থেকে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করত। এই ব্যবস্থায় ইংরেজরা দেশীয় ব্যবসায়ীদের পণ্যমূল্যের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দিয়ে নির্দিষ্ট শর্তে পণ্য ক্রয়ের জন্য চুক্তি করত। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় কোম্পানি ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে 'এজেন্সি ব্যবস্থা' চালু করে। কোম্পানির কর্মচারীরাই এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। তারা তাঁতি, নীলচাষি ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদকদের জোর করে টাকা দাদন দিত। দাদনের বিনিময়ে ভারতীয় উৎপাদকরা প্রচুর লােকসানেও পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হত।


[8] বাের্ড অব ট্রেড গঠন: দেশীয় উৎপাদকের প্রতি বঞ্চনার ফলে দরিদ্র কৃষক ও কারিগরদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে এবং কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নানা সংকটের সম্মুখীন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানির পরিচালক সভা 'বাের্ড অব ট্রেড’ গঠন (১৭৭৪ খ্রি.) করে তার ওপর কোম্পানির বাণিজ্য-সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব দেয়।


উপসংহার: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ অর্জন করে তা ভারত থেকে বিলেতে পাঠিয়ে দেয়। ফলে ভারতের ক্রমাগত দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায় এবং বিলেতের সমৃদ্ধি বাড়ে।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্রিটিশ রাজস্ব ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অব-শিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলােচনা করাে।


'অব-শিল্পায়ন' বলতে কী বােঝ? ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে অব-শিল্পায়নের ফলাফল সম্পর্কে আলােচনা করাে।