ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্রিটিশ রাজস্ব ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।
সূচনা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বৃহদংশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে। এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের বেশ কিছু অংশে রায়তওয়ারি, গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে মহলওয়ারি এবং পাঞ্জাবে ভাইয়াচারি নামে ভূমিব্যবস্থা চালু করে।
ব্রিটিশ রাজস্বব্যবস্থার প্রভাব
[1] কৃষকের অধিকার বিলুপ্ত: কোম্পানির ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় জমিতে সরকার বা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সরকারের অনুগত জমিদারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষক জমিতে তার স্বত্ব বা অধিকার হারিয়ে একপ্রকার ভাড়াটিয়া প্রজায় পরিণত হয়। তারা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের প্রজা এবং রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে সরকারের প্রজা। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষককে জমির মালিক বলে ঘােষণা করা হলেও বাস্তবে জমির ওপর কৃষকের অধিকার ছিল খুবই সামান্য।
[2] রাজস্বের উচ্চ হার: ব্রিটিশ কোম্পানি প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকদের ওপর উচ্চ হারে ভূমিরাজস্ব চাপানাে হয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে প্রজার কাছ থেকে জমিদার ইচ্ছামতাে রাজস্ব আদায় করতে পারতেন। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসলের ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত। কৃষকরা এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশােধে প্রায়ই ব্যর্থ হত। রাজস্ব পরিশােধে ব্যর্থ কৃষককে কখনাে জমিদার, কখনাে গ্রামের প্রধান, কখনাে সরকারি কর্মচারীদের শােষণ ও অত্যাচারের শিকার হতে হত।
[3] জমি থেকে উৎখাত: ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় জমিতে কৃষকের মালিকানা স্বীকৃত না হওয়ায় তারা জমি থেকে সর্বদা উৎখাতের আশঙ্কায় ভুগত। কৃষকের ওপর যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব চাপানাে হত তা পরিশােধের ক্ষমতাই কৃষকের থাকত না। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশােধে ব্যর্থ হয়ে কৃষকরা ঘনঘন জমি থেকে উৎখাত হত।
[4] জমিদারের ক্ষমতা বৃদ্ধি: জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূস্বামী বা জমির মালিকে পরিণত হন। জমি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং জমিদার জমি বিক্রয়, দান বা বন্ধক রাখার অধিকার লাভ করেন। এর ফলে কৃষকের ওপর জমিদারদের সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
[5] মহাজনদের শােষণ: ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকদের ওপর চাপানাে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব নগদ অর্থে পরিশােধ করতে হত। রাজস্ব পরিশােধ করার উদ্দেশ্যে কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। কৃষক শেষপর্যন্ত ঋণ পরিশােধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতা মহাজন তার সর্বস্ব দখল করে নিত। এভাবে দরিদ্র কৃষক ভূমিদাসে পরিণত হত।
[6] মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান: জমিদার প্রত্যক্ষভাবে কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় না করে তার অধস্তন কর্তৃপক্ষের হাতে এই দায়িত্ব দিত। এভাবে জমিদার ও কৃষকের মাঝখানে অন্তত পাঁচ-ছয় জন মধ্যস্বত্বভােগী বা উপস্বত্বভােগীর আবির্ভাব ঘটে। কৃষকদের ওপর তীব্র অত্যাচার চালিয়ে যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। পরবর্তীকালে এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ হিসেবে পরিচিত হয়।