লর্ড কর্নওয়ালিশ কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন? মহলওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি ও ত্রূটিবিচ্যুতি গুলি উল্লেখ করাে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক

লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করলেও তিনি এই বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন না। কর্নওয়ালিশ এই বন্দোবস্ত চালু করার পূর্বেই এই ব্যবস্থার পক্ষে বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন—


  • [1] কোম্পানির কর্মচারী ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাও প্রথম ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলেন। 

  • [2] এরপর হেনরি পাত্তুলাে, ড্যাক্রিস, টমাস ল প্রমুখ কর্মচারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে যুক্তি দেখান। 

  • [3] ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে তার পরিষদের সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস কোম্পানির পরিচালক সভার কাছে। এক স্মারকলিপি দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে সুপারিশ করেন। 

  • [4] ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনেও চিরস্থায়ী ব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়।


সুতরাং কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন না। তাই ড. নরেন্দ্রকৃয় সিংহ বলেন যে, “কর্নওয়ালিশকে সীমিত অর্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক বলা যায়।” লর্ড বেন্টিংকের আমলে মহলওয়ারি বন্দোবস্তকে আরও ঢেলে সাজানাে হয়। তিনি এই ব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ ঘটান এবং রবার্ট বার্ড-কে এই ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর করার দায়িত্ব দেন।


মহলওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি


১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বৃহদংশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হলেও উত্তর ভারত ও অন্যান্য স্থানের কিছু কিছু স্থানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার বিষয়ে কোম্পানির কর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে মহলওয়ারি ব্যবস্থা নামে এক ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত চালু করে। এই ব্যবস্থার প্রবর্তনে এলফিনস্টোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই ব্যবস্থার প্রধান শর্তগুলি ছিল


[১] বন্দোবস্ত: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি মহল বা তালুক তৈরি হত এবং গ্রামের ওপর সামগ্রিকভাবে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত। ২০ থেকে ৩০ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হত।


[২] ইজারা প্রদান: সরকাবদ্ধত্নকে রাজস্ব দেওয়ার শর্তে কোনাে একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তিকে যৌথভাবে কোনাে নির্দিষ্ট অঞ্চল অর্থাৎ মহল (Mahal)-এর ইজারা দেওয়া হত। ইজারা প্রাপক গ্রামের মােড়ল বা প্রধান রাজস্ব আদায় করে সরকারের কাছে জমা দিত।


[৩] রাজস্বের হার: জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে রাজস্বের হার নির্ধারিত হত। সরকার সমগ্র গ্রামের ওপর যে রাজস্ব ধার্য করত তা প্রদানের দায়িত্ব গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। এই ব্যবস্থায় আদায় করা রাজস্বের ৮০ শতাংশ সরকার এবং ২০ শতাংশ ইজারাদারের প্রাপ্য ছিল।


[৪] মধ্যস্বত্বভােগীর অনুপস্থিতি: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষক ও সরকারের মাঝখানে জমিদারের মতাে কোনাে শােষক মধ্যস্বত্বভােগীর অস্তিত্ব ছিল না। ফলে জমিদারদের শােষণের কোনাে সুযােগ ছিল না।


মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ত্রূটিবিচ্যুতি


[১] উৎখাতের আশঙ্কা: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষক নয়, সরকার ছিল জমির প্রকৃত মালিক। ফলে অধিকারহীন কৃষক জমি থেকে সর্বদা উৎখাত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগত।


[২] শােষণ: এই ব্যবস্থায় কৃষকদের ওপর জমিদারের পরিবর্তে সরকারের প্রত্যক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


[৩] বিপুল রাজস্ব: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় রাজস্বের হার যথেষ্ট বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ানাে হত। ফলে কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় হয়ে পড়ে।


[৪] অত্যধিক কঠোরতা: এই ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। ফলে বহু কৃষক তাদের জমি হারিয়ে জীবিকাহীন হয়ে পড়ে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৯৫ হাজার জমির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়।


লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল আলােচনা করাে।


রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ফলাফলগুলি উল্লেখ করাে।