লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল আলােচনা করাে।

সূচনা: বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ ভারতে প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এই বন্দোবস্তের প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল: ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, "১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ জাতির গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ ও সফল পদক্ষেপ।" মার্শম্যানের মতে, "এটি (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) ছিল একটি দৃঢ়, সাহসিকতাপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ।" এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন সুফলগুলি সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল一


  • বাজেট তৈরির সুবিধা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয়।


  • উৎখাতের সম্ভাবনা হ্রাস: কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদেরও সুবিধা হয়। তারা ইজারাদারদের শােষণ এবং জমি থেকে ঘন ঘন উৎখাতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।


  • কৃষির উন্নতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির ওপর জমিদারের স্বত্ব বা অধিকার সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা নিজ এলাকার জমি ও কৃষির উন্নতিতে যত্নবান হন।


  • ব্রিটিশদের অনুগত গােষ্ঠী: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকারের অস্তিত্বের ওপর জমিদারদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। তাই জমিদাররা সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষার চেষ্টা করে।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল


  • জমিদারির অবসান: 'সূর্যাস্ত আইন' অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি কোশাগারে রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে বহু পুরােনাে জমিদার তাদের জমিদারি হারান।


  • নতুন জমিদারদের উত্থান: পুরােনাে বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারালে শহুরে ধনী বণিকরা এই জমিদারিগুলি কিনে নেন। এসব ভুঁইফোড় নতুন জমিদারদের গ্রামের কৃষক ও জমির সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক বা প্রজাকল্যাণের কোনাে ইচ্ছা ছিল না। প্রজাদের শােষণ করে বেশি অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।


  • কৃষকদের উচ্ছেদ: অনেকেই মনে করেন যে এই ব্যবস্থায় জমিদার বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষিকে জমি থেকে ঘন ঘন উৎখাত করত। কারণ এই বন্দোবস্তে জমিতে কৃষকের কোনাে স্বত্ব বা অধিকার ছিল না। চাষির রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষির জিনিসপত্র নিলাম করত।


  • জমির উন্নতি ব্যাহত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমির মালিকানা না পাওয়ায় চাষিরা জমির উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করত না। জমিদাররাও জমির আয় নিজেদের বিলাসব্যসনে ব্যয় করত। ফলে জমি ও কৃষির উন্নতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়।


  • সরকারের লােকসান: সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া জনসংখ্যাবৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পতিত জমি উদ্ধার প্রভৃতি থেকে জমিদারের আয় বহুগুণ বাড়লেও এই বাড়তি আয়ের কোনাে অংশ সরকার পেত না।


  • কৃষকের দুরবস্থা: কৃষকের ওপর বিপুল পরিমাণ রাজস্বের বােঝা চাপিয়ে তা আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর তীব্র শােষণ ও অত্যাচার চালানাে হয়। উনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই রামমােহন রায়, লালবিহারী দে, হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তের দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।


  • শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে দ্রুত বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় বহু মানুষ ব্যাবসাবাণিজ্য ছেড়ে জমিদারির দিকে ঝুঁকে পড়ে। বেশিরভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলার কৃষকদের দুরবস্থার জন্য রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর বাংলার কৃষক গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই দায়ী করেছেন।


  • মধ্যস্বত্বভােগীর উত্থান: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার ও জমিদারের মাঝখানে পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার, দরদর-পত্তনিদার প্রভৃতি বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এসব মধ্যস্বত্বভােগীরা সীমাহীন আর্থিক শােষণ চালিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।


উপসংহার: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রকৃত অর্থে ভারতের স্বার্থে নয়। ব্রিটিশের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়।


পলাশির যুদ্ধের পরবর্তীকালে বাংলায় কীভাবে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা (১৭৬৫-৭২ খ্রি.) চালু হয়? দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ফলাফল


ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ভারতে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কে আলােচনা করাে।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য কী ছিল? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট, শর্তাবলি ও প্রভাব আলােচনা করাে।