চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য কী ছিল? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট, শর্তাবলি ও প্রভাব আলােচনা করাে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য

কর্নওয়ালিশ বড়ােলাট হয়ে ভারতে এসে (১৭৮৬ খ্রি.) ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন। তার শাসনকালে এটি ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পেছনে বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল, যেমন一


[1] সমর্থক গােষ্ঠীর উদ্ভব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের অনুগামী একটি নতুন অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটবে।


[2] সুনিশ্চিত আয়: কোম্পানির আশা ছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে তারা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে। এর ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা দূর হবে।


[3] বাজেট তৈরির সুবিধা: রাজস্ব থেকে প্রতি বছর সুনিশ্চিত আয় হলে সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ সহজ হবে।


[4] দেশের সমৃদ্ধি: জমিতে স্থায়ী অধিকার পেয়ে জমিদাররা কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করবেন। এতে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরােক্ষে কোম্পানিরই লাভ হবে।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট


[1] হেস্টিংসের ভূমিব্যবস্থার ত্রুটি: ওয়ারেন হেস্টিংসের ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত (১৭৭২ খ্রি.) এবং একসালা বন্দোবস্ত (১৭৭৭ খ্রি.) যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এই ব্যবস্থার দ্বারা সরকারের বার্ষিক আয়ের কোনাে নিশ্চয়তা ছিল না। এসব ত্রুটি দূর করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দিয়ে কর্নওয়ালিশকে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাঠান।


[2] দশসালা বন্দোবস্ত: কর্নওয়ালিশ জন শােরের কিছু বক্তব্যে আকৃষ্ট হন। বন্দোবস্ত সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনার পর তিনি ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলা ও বিহারের এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘােষণা করেন। এই ব্যবস্থা দশসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলি


লর্ড কর্নওয়ালিশ বিলাতের পরিচালক সভার অনুমােদন পেয়ে দশসালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে (২২ মার্চ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেন। প্রথমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এবং পরে বারাণসী, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় বলা হয় যে


  • [1] জমির প্রাপক জমিদার-তালুকদাররা বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভােগদখল করতে পারবেন। 

  • [2] জমিদার ইচ্ছামতাে জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবেন। 

  • [3] ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের হারেই বহাল থাকবে। 

  • [4] নির্ধারিত ভূমিরাজস্বের শতকরা ৮৯ ভাগ সরকার ও ১১ ভাগ জমিদার পাবেন। 

  • [5] সূর্যাস্ত আইন অনুসারে জমিদাররা সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে পরিশােধ করতে বাধ্য থাকবে। 

  • [6] নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব পরিশােধে ব্যর্থ হলে তাকে সমগ্র জমিদারি বা তার অংশ বিক্রি করে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব মেটাতে হবে। অন্যথায় জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে। 

  • [7] ভবিষ্যতে খরা, বন্যা, মহামারি বা অন্য কোনাে প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মকুব করা হবে না।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব


বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই ব্যবস্থা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূমি ও সমাজ উভয়ক্ষেত্রেই এক বিরাট পরিবর্তন আনে। জে. সি. মার্শম্যান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ব্রিটিশ সরকারের এক দৃঢ়, সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গভীর প্রভাব পড়েছিল।


ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে স্থায়ী সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা ও প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ভারতে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কে আলােচনা করাে।