পলাশির যুদ্ধের পরবর্তীকালে বাংলায় কীভাবে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা (১৭৬৫-৭২ খ্রি.) চালু হয়? দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ফলাফল

বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন

বাংলার নবাব মিরকাশিম, অযােধ্যার নবাব সুজাউদদৌলা এবং দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনী বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। এরপর বাংলায় ইংরেজদের ধারাবাহিক অগ্রগতি শুরু হয়।


[1] দেওয়ানি লাভ: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলার নবাব নজম-উদদৌলার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর দ্বারা নবাবের সকল 'নিজামতি' বা প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির মনােনীত 'নায়েব-নাজিম’-এর হাতে চলে যায়। নবাব কোম্পানির বৃত্তিভােগীতে পরিণত হন। ইংরেজ কোম্পানি পরাজিত মােগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির (১৭৬৫ খ্রি.) দ্বারা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে।


[2] নায়েব-নাজিম নিয়ােগ: কোম্পানি বাংলায় মহম্মদ রেজা খাঁ-কে এবং বিহারে সিতাব রায়-কে নায়েব-নাজিম অর্থাৎ নায়েব-সুবা পদে নিযুক্ত করে তাদের হাতে বাংলা ও বিহারের নিজামত ও দেওয়ানি বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করে। তারা আইনত নবাবের অধীনে হলেও বাস্তবে নবাব নয়, কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে তাদের প্রধান কাজ ছিল কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করা।


[3] দ্বৈত শাসনের প্রচলন: নায়েব নাজিমদের হাতে কোম্পানি নবাবের যাবতীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করলে কোম্পানির লােকজনই সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে আইনত নবাবের হাতে বাংলার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব থাকলেও তাঁর হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। আবার কোম্পানির হাতে প্রকৃত ক্ষমতা থাকলেও তারা প্রশাসন পরিচালনা ও প্রশাসনিক ব্যয় বহনের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এভাবে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় নবাব ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানি দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ করে। বাংলায় নবাব ও কোম্পানির এই দ্বিমুখী শাসন ইতিহাসে দ্বৈত শাসন (Diarchy) নামে পরিচিত।


দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ফলাফল


[1] শােষণ: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি বাংলায় তীব্র আর্থিক শােষণ শুরু করে। দেওয়ানি লাভের আগে ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এক বছর পর দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি ১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রায় দ্বিগুণ—২ কোটি ২০ লক্ষ। ফলে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে।


[2] কৃষকদের উৎখাত: দেওয়নি লাভের পর ইংরেজরা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানে প্রতিশ্রুতিদানকারী ইজারাদারকে জমি ইজারা দিতে শুরু করে। কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশােধ করতে গিয়ে ইজারাদারও কৃষকদের ওপর রাজস্বের হার অত্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এই রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।


[3] বাংলার রাজস্ব ব্যবহার: দেওয়ানি লাভের পর ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানাে বন্ধ হয় এবং বাংলার রাজস্বের অর্থ দিয়ে পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা হয়। এই পণ্য বিক্রির লাভের অর্থ বিলেতে চলে যেতে থাকে।


[4] একচেটিয়া বাণিজ্য: কোম্পানি বাংলায় লবণ, সুপারি, তামাক ও অন্যান্য কয়েকটি পণ্যের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায়। এর ফলে দেশীয় বণিকরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়।


[5] লুণ্ঠন: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন শুরু করে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ক্লাইভ বলেছেন যে, "আমি শুধু এটুকুই বলছি যে, পৃথিবীর আর কোনাে দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন-শােষণের ঘটনা কেউ শােনেনি বা দেখেনি- যতটুকুর লীলাক্ষেত্র হয়েছিল এই বাংলাদেশ।"


[6] দুর্নীতি: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কোম্পানির কর্মচারী বােল্টস্ লিখেছেন যে, কোম্পানির কর্মচারীদের নির্যাতন ও দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল।


[7] বিশৃঙ্খলা: দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলার সমাজ ও জনজীবনে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক জন কে বলেছেন যে, "দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল করে তােলে।"


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পুলিশি ব্যবস্থার বিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে স্থায়ী সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা ও প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।