ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করাে।

সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এদেশে আধুনিক ধাঁচের আমলাতন্ত্রের বিকাশ। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেটিং অ্যাকটের মাধ্যমে ভারতের গভর্নর-জেনারেলের পদ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে তার অধীনে ভারতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে।


আমলাতন্ত্রের বিকাশ

আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ ভারতে প্রকৃত আমলাতন্ত্র গড়ে তােলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। তিনি ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বড়ােলাট যুক্ত হয়ে এবিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন, যেমন


  • [i] কোম্পানির কর্মচারীদের কাজকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়, যথা—[a] রাজনৈতিক কাজ ও [b] বাণিজ্যিক কাজ। 

  • [ii] কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও সব ধরনের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ করা হয়। 

  • [iii] কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি ও নীতির প্রবর্তন করা হয়। এই কর্মপদ্ধতি কোড কর্নওয়ালিশ নামে পরিচিত। এভাবে কর্নওয়ালিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রবর্তন করেন।


প্রশিক্ষণ কলেজ: ভারতে ব্রিটিশ আমলাদের কাজের জন্য ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি ও সংস্কৃতির বিষয়ে জ্ঞানের খুবই প্রয়ােজন ছিল। এই প্রয়ােজনীয়তা মেটানাের উদ্দেশ্যে বড়ােলাট লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ আমলারা কাজে নিযুক্ত হওয়ার আগে এখানে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ নেওয়ার নিয়ম করা হয়। পরবর্তীকালে কোম্পানির পরিচালকবর্গের আপত্তিতে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিবর্তে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের কাছে হার্টফোর্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরে হেইলেবেরিতে স্থানান্তরিত হয়। ভারতে আমলা পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য সকল প্রার্থীকে এই কলেজে দুবছরের প্রশিক্ষণ নিতে হত।


যােগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা: 


  • [i] ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত হওয়ার জন্য ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট-এ প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। 

  • [ii] ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইন অনুসারে, জন্মসূত্রে রানির সাম্রাজ্যের ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি সকল প্রজাই এই প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় বসার অধিকার পায়। 

  • [iii] সেই অনুসারে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে লন্ডনে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আই. সি. এস. পরীক্ষা শুরু হয়। 

  • [iv] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে হেইলেবেরি কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সিভিল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।


ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনা: আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন পদে ভারতীয়রা প্রবেশের খুব বেশি সুযােগ পায়নি। 


  • [i] কর্নওয়ালিশ ভারতীয়দের দুর্নীতিপরায়ণ মনে করে সরকারের উচ্চপদগুলিতে ভারতীয়দের নিয়ােগ নিষিদ্ধ করেন। 

  • [ii] প্রথমদিকে প্রশাসনের নিম্নপদে কিছু ভারতীয় নিয়ােগের সুযােগ পেলেও ৫০০ পাউন্ড বা তার বেশি বেতনের উচ্চপদগুলিতে ভারতীয়দের নিয়ােগের সুযােগ ছিল না। 

  • [iii] অবশ্য ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অবাধ প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে আমলাদের নিয়ােগ শুরু হলে উচ্চপদগুলিতে কিছু কিছু ভারতীয় প্রবেশের সুযােগ পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেসব পদে ভারতীয়দের নিয়ােগে বাধা অব্যাহত ছিল।


সিভিল সার্ভিস আন্দোলন: ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার কয়েকটি বিষয়ের বিরােধিতা করে আন্দোলন শুরু করে। 


  • [i] লর্ড লিটন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। 

  • [ii] পরীক্ষার্থীদের বয়সের উর্ধ্বসীমা ২২ বছর করার দাবি জানানাে হয়। 

  • [iii] ইংল্যান্ডের মতাে ভারতেও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণের দাবি জানানাে হয়। লর্ড রিপন (১৮৮০-৮৪ খ্রি.) ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষপাতী হলেও উচ্চপদস্থ বহু ইংরেজ কর্মচারীর বিরােধিতায় তা কার্যকর হতে পারেনি। অবশেষে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থায় সংস্কার করা হয়।


উপসংহার: ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে 'ভারতীয় সিভিল সার্ভিস' বা আমলাতন্ত্র সমগ্র বিশ্বে একটি সুদক্ষ ও ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতীয় আমলারা সততা, দক্ষতা, স্বাধীনচিত্ততা, কঠোর পরিশ্রম প্রভৃতির ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য ও নজির সৃষ্টি করে। ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে ব্রিটিশ শাসনের 'ইস্পাত কাঠামাে' (Steel-frame) বলা হত।


১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেটিং আইনের শর্তাবলি কী ছিল? রেগুলেটিং আইনের মূল্যায়ন করাে।


ব্রিটিশ শাসনকালে প্রবর্তিত বিভিন্ন চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইনগুলির বিবরণ দাও।


ব্রিটিশ শাসনকালে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রবর্তিত ১৮৫৮, ১৮৬১ ও ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের বিবরণ দাও।