ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অব-শিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলােচনা করাে।

সূচনা: অব-শিল্পায়ন বলতে বােঝায় শিল্পায়নের বিপরীত বা শিল্পের অধােগতি। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে, যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে ও শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অব- শিল্পায়ন বলে। অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অব-শিল্পায়ন সম্পর্কে প্রথম পর্বে দাদাভাই নওরােজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গােবিন্দ রাণাডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি. ডি. বসু, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচি প্রমুখ ঐতিহাসিক আলােচনা করেছেন।


অব-শিল্পায়নের কারণ

[1] কাঁচামালের রপ্তানি: ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খােলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ভারত থেকে তুলল, নীল, কফি, চা, রেশম প্রভৃতি ইংল্যান্ডে পাঠানাে হতে থাকে। এই কাঁচামাল বিলেতে শিল্পের অগ্রগতিতে সহায়তা করে। ফলে কাঁচামালের অভাবে দেশীয় শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।


[2] শিল্পবিপ্লব: অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লবের সূচনা হয়। যন্ত্রের সাহায্যে অনেক কম সময়ে অনেক উন্নত মানের ও সস্তা শিল্পপণ্য, বিশেষ করে সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ডের কলকারখানাগুলিতে তৈরি হতে থাকে। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে সরকার ভারতের দরজা ইংল্যান্ডের বণিকদের কাছে খুলে দিতে বাধ্য হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে। ইংল্যান্ডের অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে ভারতে আসতে থাকে। তারা এদেশে জমিজমা কিনে তাতে নীল, কফি, রবার, তামাক প্রভৃতির চাষ শুরু করে এবং কাঁচামাল ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলব্যবস্থা চালু হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ পণ্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে। এসব পণ্য ভারতের বাজার ছেয়ে গেলে দেশের বাজারে দেশীয় পণ্য বিক্রি দারুণভাবে মার খায়।


[3] সুতিবস্ত্রে শুল্ক আরােপ: একদা ইংল্যান্ড-সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা হ্রাস করে বিলেতি বস্ত্রের চাহিদাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক চাপায়। এর ফলে ব্রিটেনে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে এর চাহিদা হ্রাস পায়।


[4] অসম শুল্কনীতি: কোম্পানি নিজে বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের সুযােগ নিলেও ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন দেশীয় শিল্পপণ্যের ওপর বিশাল শুল্ক আরােপ করে।


[5] অবাধ বাণিজ্যনীতি: ব্রিটিশ সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটায়। ফলে সকল ইংরেজ বণিকের জন্য ভারতের বাণিজ্যের দরজা খুলে যায় এবং দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


[6] নির্যাতন: ভারতীয় শিল্পী ও কারিগরদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও বঞ্চনা দেশীয় শিল্পের যথেষ্ট ক্ষতি করে। বাংলার তাঁতিরা কীভাবে শােষিত হত তা উইলিয়াম বােল্ট-এর রচনা থেকে জানা যায়। কোম্পানির কর্মচারী ও দালালরা তাঁতিদের অগ্রিম দাদন নিতে এবং শুধু ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুতিবস্ত্র বুনতে বাধ্য করত। দাদন গ্রহণকারী তাঁতিরা লােকসান স্বীকার করে বাজারের চেয়ে অন্তত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে তাদের বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভেরেলস্ট লিখেছেন যে, বহু তাতি তাদের ব্যাবসা ছেড়ে দেওয়ায় ঢাকা, মুরশিদাবাদ, আগ্রা, বারাণসী, সুরাট, আমেদাবাদ প্রভৃতি শহরগুলি জনশূন্য ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে।


[7] মূলধনের অভাব: অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান সেখানকার শিল্পবিপ্লবকে সহজ করে তােলে। কিন্তু এই সময় ভারতে মূলধনের যথেষ্ট অভাব ছিল। তা ছাড়া কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে এদেশের অর্থ সম্পদ শােষণ করে বিলেতে পাচার করলে এদেশের দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকার ভারতে শিল্পের বিকাশ না ঘটিয়ে ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে গড়ে তােলার নীতি গ্রহণ করে।


উপসংহার: কেবল সুতিবস্ত্রই নয়—রেশম ও পশমজাত দ্রব্য, লােহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলােয়ার, খােদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতি দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংস হয়। দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারতের দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। শিল্প বাণিজ্য থেকে বহু মানুষ কৃষিকাজে যােগ দিলে জমিতে চাপ পড়ে।


ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের রাজস্ব ব্যবস্থার পরিচয় দাও।