উনিশ শতকে বাংলার ইতিহাসে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ভূমিকা লেখাে৷

ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ভূমিকা

[1] ভূমিকা: ফরাসি বিপ্লবের মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং রুশাে, ভলতেয়ার, হিউম, লক, বেকান, টমপেইন, বেন্থাম, রিড প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকের যুক্তিবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক যুব সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিওর নেতৃত্বে তারা হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ ঘােষণা করেন, যা নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক তারাচাঁদের মতে一 "রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে তারা যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন তার ফলে চিন্তাজগতেও বিপ্লব ঘটেছিল।"


[2] মতাদর্শ: দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত কুসংস্কার প্রচলিত ছিল সেগুলির বিরুদ্ধে নব্যবঙ্গীয়রা সােচ্চার হয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সমস্ত ভণ্ডামি বা লােক দেখানাে নিয়মকানুন ছিল সেগুলির অবসান ঘটাতে তারা জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথাসহ বেশ কিছু কুপ্রথাকে সমূলে বিনাশ করার আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের প্রতি ডিরােজিওর শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল—“স্বাধীন চিন্তার দ্বারা মত ও পথ স্থির করবে, কোনাে প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুশীলন করবে না, জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করবে, সৎগুণ। অনুশীলন করবে, আর যা কিছু অন্যায় ও অসৎ তা পরিহার করবে।”


[3] গােষ্ঠীর সদস্যগণ: ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় গােষ্ঠীর সদস্যগণ হলেন রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃয় মল্লিক, কৃয়মােহন বন্দোপাধ্যায়, রামগােপাল ঘােষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, লালবিহারী দে, মাধবচন্দ্র মল্লিক, তারাচাদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব, কিশােরীচাদ মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাধানাথ শিকদার, কাশীপ্রসাদ ঘােষ, মহেশচন্দ্র ঘােষ প্রমুখ। অধ্যাপক সুশােভন সরকারের মতে- "ডিরােজিয়ানরা তাদের শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শেষ পর্যন্ত অনুগত ছিলেন এবং নিজেরা পারস্পরিক সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ ছিলেন।"


[4] কার্যাবলি: ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয়রা সে সময়কার সমাজের জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথাসহ বিভিন্ন কুসংস্কার ও নানা আর্থসামাজিক কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন। ডিরােজিয়ানরা হিন্দু সমাজের নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে বলতেন— "আমরা গােরু খাই গাে।" কালীঘাটের মা কালীকে সম্বােধন করেন, গুড মর্নিং ম্যাডাম বলে। ডিরােজিয়ানরা ফ্রান্সের ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কলকাতার টাউন হলে এক বিজয় উৎসব পালন করে ও ফরাসি বিপ্লবের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা মনুমেন্টে (এখনকার শহিদ মিনার) টাঙিয়ে দেয় (২৫ ডিসেম্বর)। নব্যবঙ্গীয়রা সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার তীব্র সমালােচনা করেন। আসলে নব্যবঙ্গীয়রা সমকালীন হিন্দু সমাজব্যবস্থা ও হিন্দুধর্মের গোঁড়ামিগুলিকে সহ্য করতে পারত না।


[5] অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন গঠন: ডিরােজিও তার অনুগামীদের নিয়ে মানিকতলায় শ্রীকৃয় সিংহের বাগানবাড়িতে গঠন করেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন নামক এক বিতর্কসভা (১৮২৮ খ্রি.)। ডিরােজিও নিজে ছিলেন এর সভাপতি এবং ডিরােজিওর ছাত্র উমেশচন্দ্র বসু ছিলেন এর সম্পাদক। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন। অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনের বিভিন্ন অধিবেশনে সনাতন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতার ওপর আলােচনা ও বিতর্ক চলত।


[6] বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ: ডিরােজিওর অনুগামী ছাত্ররা পার্থেনন নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৮৩০ খ্রি.)। এই পত্রিকায় তারা হিন্দুসমাজের বিভিন্ন কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করেন। হিন্দু কলেজের সহসভাপতি প্রাচ্যবাদী হােরেস হেম্যান উইলসন এই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগেই এটি বন্ধ করে দেন। কৃয়মমাহন বন্দ্যোপাধ্যায় পার্সিকিউটেড পত্রিকায়, মাধবচন্দ্র মল্লিক বেঙ্গল হরকরা পত্রিকায় হিন্দুসমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখেন। নব্যবঙ্গীয়দের প্রচেষ্টায় সােসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ নামক এক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে (১৮৩৮ খ্রি.)। ডিরোজিও নিজেও একই লক্ষ্য নিয়ে 'হেসপেরাস', 'ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’, ‘ক্যালাইডােস্কোপ' ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। ডিরােজিওর অনুগামীরা ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় জ্ঞানান্বেষণ ইংরেজি ভাষার 'দি এনকুয়েরার', বেঙ্গল স্পেকটেটর, 'হিন্দু পাইওনিয়ার' নামক পত্রিকা প্রকাশ ও সাধারণ জ্ঞানােপার্জিকা সভা (১৮৩৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ধারা বজায় রাখেন। ডিরােজিও রচিত 'ফকির অব জাংঘিরা’, ‘টু ইন্ডিয়া মাই নেটিভ ল্যান্ড’—কবিতাগুলিতে তার ভারতপ্রেমের পরিচয় মেলে।


[7] আন্দোলনের অবসান: ডিরােজিওর মৃত্যুর পর থেকেই ক্রমশ নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন উপযুক্ত নেতার অভাবে শ্লথ হয়ে পড়ে। ডিরােজিওর অনুগামীদের অনেকেই সমাজসংস্কারের পথ থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন এবং প্রাচীন হিন্দুত্ববাদী ধর্মের সঙ্গে নিজেদেরকে অঙ্গীভূত করে নেন।


উপসংহার: ডিরােজিওর নেতৃত্বে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা চলে না। নব্যবঙ্গীয়দের মধ্যে প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পাশ্চাত্য আদর্শের সূর্যালােক প্রতিফলিত হয়েছিল। সাময়িকভাবে হলেও নব্যবঙ্গীয়রা ভারতবর্ষের সমকালীন সমাজব্যবস্থা, ধর্মনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আলােড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।