ভারতীয় নারীর কল্যাণে রামমােহন ও বিদ্যাসাগরের প্রয়াস আলােচনা করাে।

ভূমিকা: পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ও উদারনৈতিক চিন্তাধারা উনিশ শতকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে প্লাবন এনেছিল রামমােহন ও ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন তার দুই স্মরণীয় বাহক।


নারীকল্যাণে রামমোহনের প্রয়াস

[1] নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা: রামমােহন স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকারে একান্তভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। নারীজাতিকে পুরুষের সঙ্গে একাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে ভারতীয় সমাজের প্রকৃত উন্নতি অসম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন। তাই সম্পত্তিতে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি সােচ্চার হয়েছিলেন।


[2] সতীদাহপ্রথা নিবারণ: নারীজাতির কল্যাণসাধনে রামমােহনের সর্বাপেক্ষা সফল প্রচেষ্টা হল সতীদাহপ্রথা নিবারণ আন্দোলন। এর সাহায্যে সমাজে নারীজাতির অমর্যাদা ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তিনি তীব্র বিরােধিতা করেছিলেন। ১৮০০-১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে ২ হাজার ৩৬৫ জন বিধবাকে সতীরূপে দাহ করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল জনমতের সমর্থনে এবং রামমােহনের প্রচেষ্টায় বড়ােলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর আইন জারি করে সতীদাহপ্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন।


[3] স্ত্রীশিক্ষা প্রসার: স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও রামমােহন বেশ কতকগুলি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে নারীদের আধুনিকরূপে গড়ে তােলার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণদের বিরােধিতার জন্য তিনি স্ত্রীশিক্ষার সফল প্রসার ঘটাতে পারেননি।


নারীকল্যাণে বিদ্যাসাগরের প্রয়াস


[1] স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার: স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তার আগ্রহ ছিল গভীর। হিন্দু সমাজের সেই যুগে যখন মানুষের বিশ্বাস ছিল লেখাপড়া শিখলে স্ত্রীলােকের আশু বৈধব্য অনিবার্য, তখন সমস্ত কুসংস্কারকে 'অজেয় পৌরুষ'-এ উপেক্ষা করে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তার উৎসাহ ও প্রচেষ্টা ছিল অক্লান্ত। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলায় স্ত্রীশিক্ষা সম্মিলনী গঠন করেন। তিনি ফিমেল জুভেনাইল সােসাইটির সঙ্গে যুক্ত থেকে নারীদের সার্বিক উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন।


[2] বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বড়লাটের কাউন্সিলের সদস্য ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল স্থাপন করেন (যা বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত)। তিনি মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরে মেট্রোপলিটন কলেজ (আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ) নামে পরিচিতি পায়। সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শকরূপে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন; এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি তার নিজ ব্যয়ে পরিচালিত হত। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন ছাত্রী পড়াশােনা করত। ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ছােটোলাট হ্যালিডের আনুকূল্যে ঈশ্বরচন্দ্র হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া ও মেদিনীপুর জেলায় ২০টি আদর্শ বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।


[3] বাল্যবিবাহের বিরােধিতা: বাল্যবিবাহ প্রথা বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি 'সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বাল্যবিধবাদের দুঃখমােচনের জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।


[4] বিধবাবিবাহ প্রবর্তন: বিদ্যাসাগরের আর এক অনবদ্য কৃতিত্ব হল হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ আইন প্রবর্তনে সরকারের স্বীকৃতি আদায় করা। এই আইন যাতে বিধিবদ্ধ হয় তার জন্য তিনি 'সর্বশুভকরী' পত্রিকা ও তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রয়ােজন ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন। সেই সঙ্গে বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্র অনুমােদিত তা 'পরাশর সংহিতা' থেকে নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বড়ােলাট ডালহৌসি শেষপর্যন্ত হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন করেন। আর ওই আইনে স্বাক্ষর করে তা বিধিবদ্ধ করেন পরবর্তী বড়ােলাট ক্যানিং (২৬ জুলাই, ১৮৫৬ খ্রি.)। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথম যে বিধবাবিবাহটি অনুষ্ঠিত হয় (১৮৫৬ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) তাতে পাত্র ছিলেন ২৪ পরগনা জেলার শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন আর পাত্রী ছিলেন বর্ধমানের পলাশডাঙার ব্রহ্নানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা মেয়ে কালীমতি দেবী। ১৮৫৬-৬৭ খ্রি. মধ্যে বিদ্যাসাগর নিজের থেকে ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মােট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। দরিদ্র বিধবাদের বিবাহ দেওয়ার জন্য তিনি গঠন করেন 'হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড। এমনকি নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও তিনি ভবসুন্দরী নামক এক অষ্টাদশী বিধবার বিবাহ দেন।


[5] বহুবিবাহের বিরােধিতা: ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার অনুরােধ জানিয়ে ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর জোগাড় করে শাসক ব্রিটিশের কাছে এক আবেদন পাঠান। কিন্তু এই আবেদনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নেতা রাধাকান্ত দেব ব্রিটিশ সরকারের কাছে পালটা আবেদন পেশ করেন। এই পরিস্থিতিতে সরকার বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে এই সমস্যাটির কোনাে সুরাহা হয়নি।


মূল্যায়ন: ভারতীয় নারীজাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের প্রচেষ্টায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন রাজা রামমােহনের সার্থক উত্তরসূরি। তাঁদের আধুনিক মন, উদার মানবতাবাদ, চারিত্রিক কঠোরতা, বহুমুখী প্রতিভা, অসাধারণ কর্মপ্রচেষ্টা ও বাস্তবুদ্ধি ভারত তথা বাংলার সমাজ ও সভ্যতাকে গর্বিত করে।