শিক্ষা, সমাজসংস্কার ও ধর্মসংস্কারক রাজা রামমােহনের অবদান লেখো।

ভূমিকা: আধুনিক ভারতে যেসব সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন রাজা রামমােহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)। রামমােহন ভারতীয় সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে জাতিকে আলাের পথ দেখান। তাকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ, আধুনিক ভারতের জনক', 'আধুনিক ভারতের ইরাসমাস’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত। মােগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে 'রাজা উপাধি দেন। রাজা রামমােহন রায় বিশ্বাস করতেন যে জাতিকে অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদ। তাই তিনি প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ও শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারায় সমন্বয় ঘটিয়ে নবভারত গড়ে তােলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।


রাজা রামমােহন রায়ের শিক্ষাসংস্কার

[1] শিক্ষাবিষয়ক চিন্তাধারা: রামমােহনের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তায় ভারতের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের মিলন ঘটানাের প্রয়াস ছিল। তাই তিনি সারাজীবন ধরেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করে গেছেন। রামমােহনের শিক্ষাবিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে বাস্তব জগতের উপযুক্তরূপে গড়ে তােলা ও তাদেরকে সমাজকল্যাণে নিয়ােগ করে দেশ ও জাতিকে প্রগতি ও উন্নতির পথে চালিত করা।


[2] পাশ্চাত্য শিক্ষা সমর্থক: রামমােহন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল আমহাস্স্টকে এক পত্র মারফত (১৮২৩ খ্রি.) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়ের অনুরােধ জানান। এর পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিকবিদ্যা পড়ানাে হােক। তিনি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফকে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। তিনি ক্যালকাটা বুক সােসাইটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।


[3] স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠা: দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যত্নবান হন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলাে হিন্দু স্কুল (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। বেদান্ত শিক্ষার লক্ষ্যে কলকাতায় গড়ে তােলেন বেদান্ত কলেজ (১৮২৬ খ্রি.)।


[4] বাংলা গদ্যসাহিত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা: রামমােহন রচিত উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি ছিল—

  • [i] বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫ খ্রি.) 

  • [ii] বেদান্ত সার (১৮১৫ খ্রি.) 

  • [iii] ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭ খ্রি.) 

  • [iv] মাণ্ডুক্যোপনিষৎ (১৮১৭ খ্রি.) 

  • [v] মুণ্ডকোপনিষৎ (১৮১৯ খ্রি.) 

  • [vi] সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (১৮১৯ খ্রি.) 

  • [vi] সুব্রত্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার (১৮২০ খ্রি.) 

  • [vi] ব্রাহ্মণ সেবধিঃ (১৮২১ খ্রি.) প্রভৃতি।


[5] বিবিধ সংবাদপত্র প্রকাশনা: রামমােহন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন। তিনি বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি ও ফরাসি ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় 'সম্বাদ কৌমুদী' (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত 'মিরাৎ-উল-আখবর' (১৮২২ খ্রি.) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত সংবাদপত্রের উল্লেখযােগ্য নিদর্শন।


রাজা রামমােহন রায়ের ধর্মসংস্কার


[1] একেশ্বরবাদী প্রচার: রামমােহন সর্বপ্রথম ফারসি ভাষায় তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন’ শীর্ষক রচনায় পৌত্তলিকতাবাদ, অলৌকিক তত্ত্ব, বহু ঈশ্বরবাদ, অবতারবাদ ইত্যাদির বিরােধিতা করেন। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি ঘােষণা করেন সব ধর্মই মূলত একেশ্বরবাদী। তিনি বলেন পৌত্তলিকতাই হিন্দুধর্মের শেষ কথা নয়। একেশ্বরবাদী ভাবধারায় ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়কে একত্রিত করার লক্ষ্যে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, পাদরি অ্যাডামস প্রমুখের সাহায্যে 'কলিকাতা ইউনিটেরিয়াম কমিটি' গঠন করেন (১৮২১ খ্রি.)।


[2] আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা: রামমােহন হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধিতার উদ্দেশ্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা করেন। আত্মীয়সভার বিভিন্ন অধিবেশনে হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজার অসারতা, সতীদাহপ্রথা ও জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে আলােচনা হত। আত্মীয়সভার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, নন্দকিশাের বসু, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ।


[3] ব্রাহ্মসভার গঠন: একেশ্বরবাদের প্রচার ও ধর্মীয় চেতনার বিকাশের লক্ষ্যে রামমােহন ব্রাহ্মসভা গঠন (১৮২৮ খ্রি.) করেন। রামমােহন ব্রাহ্মসভার মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের রক্ষকদের গোঁড়ামিতে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেক শনিবার (পরে বুধবার) সন্ধ্যায় এই সভার প্রার্থনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ব্রাহ্মসংগীত পরিবেশন, বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা, বেদ-উপনিষদ পাঠ করা হত।


[4] বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার: রামমােহন মনে করতেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ দান। তাই তিনি বাংলা ভাষাতে বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এমনকি অদ্বৈতবাদ প্রচারের জন্য তিনি বেদান্ত কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন (১৮২৫ খ্রি.)। তিনি ঈশ, কঠ, কেন, মণ্ডুক, মাণ্ডুক্য এই পাঁচটি উপনিষদের ভাবানুবাদ করেছিলেন।


রাজা রামমােহন রায়ের সমাজসংস্কার


[1] জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা: রামমােহন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রথার তীব্র বিরােধিতা করেন। তিনি 'বজ্ৰসূচি' গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন যে, জাতিভেদ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা করেন।


[2] সতীদাহপ্রথা নিবারণ: তৎকালীন হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। এই অমানবিক কুপ্রথা সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত। এই কুপ্রথার বিরােধিতা করে রামমােহন জনমত গড়ার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান। তিনি বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে ৩০০জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে এই প্রথা বন্ধের দাবি জানান। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (৪ ডিসেম্বর) ১৭নং রেগুলেশন (Regulation-XVII) জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি এবং শাস্তিযােগ্য অপরাধ বলে ঘােষণা করেন।


[3] নারীকল্যাণ: রামমােহন নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। 

  • [i] তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে। 

  • [ii] তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

  • [iii] কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপ থেকে নারীসমাজকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান। 

  • [iv] নারীর বিবাহ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান।


[4] অন্যান্য সামাজিক সংস্কার: রামমােহন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্যপ্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। রামমােহন নারীপুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর হন।


মূল্যায়ন: রামমােহন রায়ের চরিত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ করা যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ করা হয় যে, তিনি জাতিভেদপ্রথা বা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে রুখে দাঁড়াননি। ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগের বশে তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব সমালােচনা সত্ত্বেও আধুনিক ভারত গঠনে তার অবদান অসীম। উনিশ শতকে রামমােহন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মিলন, এবং জনশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে একদিকে যেমন একজন শিক্ষা সংস্কারক হয়ে উঠেছিলেন, অপরদিকে তেমনই উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তিবাদী মননশীলতায় নিজেকে একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকরূপে প্রমাণ করেছিলেন।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল?


ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমােহনের অবদান সম্পর্কে আলােচনা করাে।