ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল?

সূচনা: অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজসংস্কার আন্দোলনের যে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে তা ভারতের সমাজজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সমাজে বহু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।


ভারতীয় সমাজে সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব

[1] সামাজিক কুসংস্কার হ্রাস: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে বহু সামাজিক কুসংস্কার দুর্বল হতে শুরু করে। আন্দোলনের চাপে কুসংস্কার আঁকড়ে থাকা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন প্রমুখ রক্ষণশীলদের সামাজিক প্রভাব যথেষ্ট খর্ব হয়। ফলে সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, অনুষ্ঠানসর্বস্বতা, কুসংস্কারের বাধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। ভারতীয় সমাজ হীনম্মন্যতা কাটিয়ে নতুন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে।


[2] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ: বিভিন্ন সংস্কারকের উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ে ভারতীয়দের গোঁড়ামি অনেকটাই দূর হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পথ সুগম হয়। আলিগড় আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সরকারও প্রয়ােজনের তাগিদে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে থাকে।


[3] সাংস্কৃতিক অগ্রগতি: সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটায়। বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্যের ভাবধারার অবাধ প্রবেশের সুযােগ করে দেয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য দর্শন আধুনিকতা, যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, বিজ্ঞানচেতনা প্রভৃতির প্রসার ঘটে। ধর্মীয় কুসংস্কার দুর্বল হয়ে প্রগতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক চেতনার প্রভাবে ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি ঘটে।


[4] জাতীয়তাবাদের বিকাশ: সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় দীক্ষিত এই প্রগতিশীল শ্রেণির চিন্তা-চেতনা থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠা করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরােধিতা করতে শুরু করে। তারা সরকারের কাছে ভারতীয়দের বিভিন্ন অধিকারের দাবি তুলে ধরে। জাতীয় চেতনার বিকাশের ফলে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।


[5] নারীকল্যাণ: সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ভারতের চির নির্যাতিত নারী জাতির প্রতি সহানুভূতির বাতাবরণ তৈরি হয়। পুরুষের বহুবিবাহ, কন্যা সন্তান হত্যা, নারীদের বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথা, পর্দাপ্রথা, পণপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সমাজের মানুষ ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে। নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানাে হয়। নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলে সমাজের সার্বিক উন্নতি ঘটে।


উপসংহার: আচার্য যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতে নবজাগরণ সংঘটিত হয়। এই নবজাগরণ সংঘটনের ক্ষেত্রে সমাজসংস্কার আন্দোলনের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বস্তুতপক্ষে, ইটালির নবজাগরণে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা যতটা ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের ক্ষেত্রে ততটা ভূমিকা নিয়েছিলেন সমাজসংস্কারকগণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সমাজসংস্কারের প্রভাবে ভারতীয় সমাজে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রথম সূচনা হয়েছিল বাংলায়।