উনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান | সমাজসংস্কারক রূপে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করাে।

সমাজসংস্কারক রূপে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন

সূচনা: বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরেই সমাজের বহুমুখী সংস্কারে ব্রতী ছিলেন। কুসংস্কার ও বিভিন্ন নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হিন্দুসমাজের নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অবিস্মরণীয়। বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরােধিতা, বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন, নারীশিক্ষার বিস্তার, উচ্চশিক্ষার প্রসার, সর্বোপরি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন।


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তন


বিধবাবিবাহ প্রবর্তন: সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। সে সময়কার হিন্দুসমাজে অত্যন্ত অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে বয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও বিবাহ হত। ফলস্বরূপ অনেক সময় অল্প বয়সেই মেয়েরা বিধবা হত। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম হিন্দু বাল্যবিধবাদের বৈধব্যকালীন জীবনযন্ত্রণা অনুভব করেন। তিনি পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।


বিধবাবিবাহের সপক্ষে আইন পাস: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবাবিবাহকে সমর্থন জানিয়ে ৯৮৭ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র ভারতীয় আইনসভার সদস্যদের কাছে পাঠানাে হয় (১৮৫৫ খ্রি. ৪ অক্টোবর)। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় লর্ড ডালহৌসির সরকার অবশেষে ১৪নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইন পাস করায় (১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই) এবং এক ঘােষণায় বলে—বিধবাবিবাহজাত সন্তান পিতার সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার পাবে।


বিধবাবিবাহ আয়ােজন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্ৰহ্বানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবীর মধ্যে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় (১৮৫৬ খ্রি. ৭ ডিসেম্বর)। এরপরে নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগর ১৮ বছরের ভবসুন্দরী নামক বিধবার বিবাহ দেন। ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি নিজের ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মােট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। দরিদ্র বিধবাদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যাসাগর হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড (১৮৭২ খ্রি.) গঠন করেন ও নিজে তার কোষাধ্যক্ষ হন। নিজ পুত্রের বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখেছিলেন—“নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।”


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহের বিরােধিতা


সে সময়কার হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। জনসাধারণকে বহুবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলির সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর দুখণ্ডের 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এই প্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধমানের মহারাজা (মহাতাব চাদ)-র সহায়তায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর-সহ কয়েকজনকে নিয়ে বহুবিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রনয়ণের জন্য এক কমিটি নিয়ােগ করে। কিন্তু মহাবিদ্রোহের পর সরকারি তরফে হিন্দু সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপে দ্বিধা থাকায় এই ব্যাপারটি খুব বেশি দূর এগােয়নি।


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহের বিরােধিতা


তৎকালীন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহ ছিল এক অভিশাপের মতাে। এই অভিশাপ মােচনের জন্য তিনি আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। বাল্যবিবাহের বিরােধিতা করে বিদ্যাসাগর সর্বশুভকারী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। বাল্যবিবাহের দোষ' নামক প্রবন্ধ লেখেন। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা খুব কম বয়সেই বিধবা হত। ফলে বাকি জীবনটা তাদের বৈধব্যের গ্লানি। ও বিভিন্ন কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে কাটাতে হত। এই অল্পবয়সি মেয়েদের জীবনের দুঃখ মােচনের জন্যই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যেভাবে সােচ্চার হয়েছিলেন তার ফলশ্রুতিরূপে ব্রিটিশ সরকার এক আইন পাস (১৮৬০ খ্রি.) করে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১০ বছর ধার্য করে।


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যান্য সামাজিক সংস্কার


বিদ্যাসাগর সে সময়কার সমাজের অন্যান্য বেশকিছু সংস্কারকে দূর করতে চেয়েছিলেন। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা, কুষ্ঠরােগী হত্যার নিয়ম, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই কুপ্রথাটির ইতিহাস পর্যালােচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র অর্থলােলুপতার জন্য এই প্রথা কতদূর হীন হতে পারে। কৌলীন্য প্রথার বলি হয়ে নারীরা সমাজে কতটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকে তা তিনি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে অনুভব করেন। তিনি হুগলি জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে দেখান যে সমাজে কৌলীন্য প্রথার সুযােগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণেরা কীভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে।


মূল্যায়ন: সমাজসংস্কারকরূপে বিদ্যাসাগর যে সমস্ত ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছিলেন তা নয়। তবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সমাজসংস্কারে নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন।