ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতায় ড. সুকর্ণ- এর অবদান আলােচনা করাে।

সূচনা: জাভা, সুমাত্রা, বাের্নিয়াে এবং একশােরও বেশি ছােটোবড়াে। দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। আঠারাে শতক থেকে এই দ্বীপ রাষ্ট্রে ডাচ বা ওলন্দাজদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে শেষপর্যন্ত ড. সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায়।


ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সুকর্ণ

[1] PNI দলগঠন: ইতিপূর্বে হল্যান্ডে গঠিত (১৯২২ খ্রি.) ইন্দোনেশিয় ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সুকর্ণ। সুকর্ণ এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে PNI দল। অল্পদিনের মধ্যে এই দল ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে। সুকর্ণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক দলটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্বেকার রাজনৈতিক দল PKI-এর জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যায়।


[2] ঔপনিবেশিক সরকারের বিরােধিতা: সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে PNI দল ইন্দোনেশিয়ার সকল অকমিউনিস্টদের একজোট করে এবং অসহযােগীতার নীতি গ্রহণ করে। এই দল কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। পাশাপাশি এই দল সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের বিরােধিতা করে।


[3] জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন: সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী দল দলীয় পতাকা হিসেবে লাল ও সাদা পতাকা গ্রহণ করে। ইন্দোনেশীয় ভাষা ও জাতীয় সংগীত ইন্দোনেশিয়া বয়া (বৃহত্তর ইন্দোনেশিয়া) গ্রহণ করে। এইভাবে এই দল ইন্দোনেশিয়াবাসীর অন্তরে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।


[4] আন্দোলন দমন: ডাচ সরকার ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে সুকর্ণ-সহ চারজন জাতীয় নেতাকে বন্দি করে, জাতীয় দল ভেঙে দিয়ে তাকে বেআইনি ঘােষণা করে। এই সময়ে এই দলের দুই নেতা মহম্মদ হাত্তা ও সুতান জাহরির বিদেশে শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ও জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার ভার নেন।


[5] পারতাই ইন্দোনেশিয়া গঠন: বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সুকর্ণ পুনরায় জাতীয় আন্দোলনে মনােনিবেশ করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ার বিচ্ছিন্ন গােষ্ঠীগুলিকে একজোট করে পারতাই ইন্দোনেশিয়া নামে এক গণ সংগঠন গড়ে তােলেন। ডাচ সরকারের কুনজরে পরে তিনি পুনরায় বন্দি হন এবং তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানাে হয়। এদিকে হাত্তা ও জাহরিরকেও নিউগিনিতে বন্দি শিবিরে পাঠানাে হয়।


[6] জাপানের ইন্দোনেশিয়া দখল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি হল্যান্ড দখল করে নিলে (১৯৪০ খ্রি.) ইন্দোনেশিয়ায় হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এই সুযােগে জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয় (১৯৪২ খ্রি.)। জাপান ঔপনিবেশিক সরকার সুকর্ণকে নির্বাসন থেকে মুক্তি দেয়। জাপানি কর্তৃপক্ষ সুকর্ণ ও হাত্তাকে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়াবাসীর সাহায্য লাভের চেষ্টা করে।


[7] প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা: জাপানকে যুদ্ধে সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়ে সুকর্ণ এক লক্ষ সেনাবিশিষ্ট এক সামরিক সংগঠন গড়ে তােলার সুযােগ পান। এ ছাড়াও তিনি জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে গােপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে সুকর্ণ স্বাধীনতার জন্য এক প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন (১৯৪৫ খ্রি., ১৪ আগস্ট)। এর তিনদিন পরে অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ আগস্ট সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘােষিত হয় ও এক প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী নেতারা সরকারের পাঁচটি নীতি অর্থাৎ পঞ্চশীল ঘােষণা করেন। এগুলি ছিল—জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সম্মতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ঈশ্বর বিশ্বাস। স্বাধীনতা ঘােষণার পর নতুন সরকার কয়েকটি সমস্যার মুখােমুখি হয়, যথা—পশীলের বিরােধিতা, PNI দলের বিভাজন ও PIR গঠন, কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান ও ক্যাবিনেট সদস্যদের অপহরণ পরিকল্পনা প্রভৃতি।


[8] ওলন্দাজদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপান হেরে গেলে ওলন্দাজরা পুনরায় ইন্দোনেশিয়ায় নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। সুমাত্রা ও জাভা বাদে ইন্দোনেশিয়ার অবশিষ্ট অংশ ওলন্দাজদের অধীনে চলে যায়। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সৈন্যরা ডাচদের পূর্ণ মদত জোগায়। শুধু তাই নয় জাভায় ঢুকে ব্রিটিশ সেনারা দু-লক্ষ ওলন্দাজ বন্দিদের মুক্ত করে। এই প্রেক্ষাপটে রানি উইলহেল মিনা ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে এক ঘােষণা জারি করেন। এই সময়ে সমগ্র ইন্দোনেশিয়া দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর এক ভাগ ছিল সুকর্ণ-এর প্রজাতন্ত্রের অধীনে আর অপর ভাগে ছিল মিত্র শক্তির সাহায্য নিয়ে হল্যান্ডদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় ইন্দোনেশিয়া ও হল্যান্ডের মধ্যে লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (২৫ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই চুক্তিতে ঠিক হয়ㅡ


  • [i] জাভার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে এক সংবিধান সভা ডাকা হবে। 

  • [ii] হল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হবে যে ইউনিয়নে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও অর্থ দপ্তর। স্বাভাবিকভাবেই ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা এই চুক্তি মেনে নেয়নি।


[9] মার্কিন উদ্যোগ ও ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা লাভ: লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে ডাচ সরকার ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশি শাসন কায়েম করেন। ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে ডাচদের বিরােধিতা করে ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি সমর্থন জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হল্যান্ড কূটনৈতিক চাপ দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে উদ্যোগী হয়।


উপসংহার: UNO-এর মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা পায়। গঠিত হয় ষােলােটি অঙ্গরাজ্য বিশিষ্ট ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্দোনেশিয়া। স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ড. সুকর্ণ এবং প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ হাত্তা। ড. সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরাধীন জাতিগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিনে ইউরােপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি আলােচনা করাে।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় ইউরােপীয় উপনিবেশ বিস্তারের বর্ণনা দাও।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত ইন্দোনেশিয়াতে ইউরােপীয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতি পর্যালােচনা করাে।