পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা কীরূপ ছিল | মন্বন্তরের পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা কীরূপ ছিল?

পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা

[1] মৃত্যুর মিছিল: মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। খাদ্যের অভাবে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে মানুষ শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অনুমান করা হয় যে, এই দুর্ভিক্ষে বাংলার অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরিমাণ এতই বেড়ে যায় যে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র মৃতদেহগুলি পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেই মৃত্যুর মিছিলের বেশ কিছু ছবি দেখতে পাওয়া যায় সমকালীন সংবাদপত্রের পাতায়। মৃত শিশু কোলে নিয়ে মায়ের কান্না, মহানগরীর রাজপথ ও গলিপথে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ ডিঙিয়ে নাগরিক জীবনের এগিয়ে চলা - প্রভৃতি সেসময়কার সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছিল।


[2] করুণ চিত্র: খাদ্যের অভাবে বাংলার সর্বত্র করুণ আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের হাহাকার: "ফ্যান দাও মা। ... ফ্যান দাও।" সেসময়ের একটি ছবিতে দেখা যায়, একটি লরি থেকে রাস্তায় গুড় পড়েছে, আর সে গুড় তুলে চেটেপুটে খাচ্ছে শিশুর দল। অনাহারী মায়ের কঙ্কালসার দেহের ওপরে তার দুধের শিশুটি কখন মারা গেছে, তা মায়ের দেখার শক্তিও নেই। একটু পরে মায়েরও মৃত্যু হয়। মৃত মানুষের মাংস খেয়ে খেয়ে মাংসাশী শেয়াল, শকুনেরও অরুচি দেখা দেয়।


[3] মধুশ্রী মুখার্জির বিবরণ: গবেষিকা মধুশ্রী মুখার্জি তাঁর 'Churchill's Secret War' নামক বইটিতে পাশের মন্বন্তরের মর্মান্তিক কাহিনির ভয়াবহতার বিভিন্ন টুকরাে চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে—


  • [i] ফরিদপুরের এক বৃদ্ধ জানিয়েছেন, তাদের জেলপটির ৫০টি পরিবারের মধ্যে সবগুলিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।


  • [ii] খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে এক দরিদ্র কৃষক তার বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।


  • [iii] এক ক্ষুধার্ত অসহায় পিতা তার কোলের সন্তানকে বিক্রি করার জন্য কোনাে ক্রেতা না পেয়ে শিশুটিকে একটি কুয়ােয় ছুঁড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।


  • [iv] চট্টগ্রামের এক ব্রিটিশ সেনা জানিয়েছেন, একবার তাদের সেনা ছাউনির গার্ড বিমর্ষ হয়ে দেখেছেন যে, একটি শিয়াল তখনও বেঁচে থাকা একটি মেয়ের হাত ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে।


  • [v] কলকাতার ফুটপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলি গণমাধ্যমে কিছুটা প্রচার পেলেও গ্রামবাংলার মৃত্যুগুলি ঘটেছে নীরবে, নিঃশব্দে। শিয়াল কুকুর মৃতদেহগুলি ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে।


পঞ্চাশের মন্বন্তরে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা


[1] সরকারি মনােভাব: সরকার বাংলার খাদ্য সংকটের তীব্রতা ও সম্ভাব্য ভয়ানক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার কোনাে চেষ্টা করেনি। বাংলার নেতা ফজলুল হক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন- "বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।" বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও আগে থেকেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়লে সরকার দুর্গতদের কাছে খাদ্য ও ত্রাণ প্রেরণেরও বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি।


[2] মজুতদারি তত্ত্বের অসারতা: সরকার মনে করত যে, অন্য কোনাে কারণে নয়, একমাত্র খাদ্যের মজুতদারির ফলেই বাংলায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু সরকার যতটা ব্যাপক মজুতদারি কল্পনা করত পুলিশি তদন্তে ততটা ব্যাপকতার প্রমাণ মেলেনি। কিছু মানুষ যেটুকু খাদ্য মজুত করেছিল তা দুর্ভিক্ষের সময়ই ফুরিয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনও বড়ােলাট লর্ড ওয়াভেল বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে এই মজুতদারির তত্ত্বকেই আঁকড়ে ছিলেন। সচেতন মানুষ আগে থেকে এটুকু খাদ্যশস্য সঞ্চয়ে না রাখলে দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ত। তাছাড়া দুর্ভিক্ষের অবসানের পর মজুত করা বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত খাদ্য বাইরে আসার প্রমাণ সরকার পায়নি।


[3] ধনীদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি: নিজের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে সরকার গুরুত্বহীন বিষয়কে অজুহাত হিসেবে উল্লেখ করে দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। সরকার মানুষকে বােঝানাের চেষ্টা করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে মুদ্রাস্ফীতির ফলে বাংলার ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ জমা হয়েছিল। এই অর্থে তারা প্রচুর খাদ্য কিনে নিলে বাংলায় সংকট শুরু হয়।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে গুজরাটের কৃষকদের দুরবস্থার পরিচয় দাও। এই সময় সেখানকার কৃষকদের ওপর করের বােঝা বৃদ্ধি প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও তার পরিণতি উল্লেখ করাে।


১৯২০-র দশকে গুজরাটের কৃষকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করাে। এই আন্দোলনের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণগুলি কী ছিল?