আঠারাে শতকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়ে ভােলার ক্ষেত্রে ইংরেজরা সব থেকে বেশি সফল হয়েছিল কেন?

সূচনা: আঠারাে শতকে ইউরােপীয় দেশগুলির মধ্যে ইংল্যান্ড উপনিবেশ গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি সফল হয়। পাের্তুগাল ও স্পেন অনেক আগে উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করলেও তাদেরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড।


উপনিবেশ গঠনে ইংল্যান্ডের সফলতার কারণসমূহ

[1] শক্তিশালী নৌবাহিনী: নৌশক্তিতে ইউরােপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংল্যান্ড অনেক গুণ এগিয়েছিল। স্পেনীয় আর্মাডাকে ধ্বংস করে ইংল্যান্ড বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নৌশক্তি হয়ে উঠেছিল। ছােটো আকারের অথচ দ্রুতগতি সম্পন্ন ব্রিটিশ নৌযানগুলি ছিল অপ্রতিরােধ্য। ইংল্যান্ডের নাবিকদের দক্ষতাও ছিল অন্যান্য নাবিকের থেকেও অনেক বেশি। টিউডর যুগের নৌশক্তির বিকাশ ইংল্যান্ডকে নতুন উপনিবেশ গঠনে সাহায্য করেছিল। রানি এলিজাবেথ ও রাজা অষ্টম হেনরির আমলে নৌ জাহাজগুলি ইংল্যান্ডের নৌশক্তির উত্থান ঘটায়।


[2] শক্তিশালী বণিক কোম্পানি গঠন: ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে গড়ে উঠেছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নবগঠিত ইংরেজ কোম্পানি সরকারি নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠেনি। অপরদিকে স্পেন, পাের্তুগাল ও ফ্রান্সে কোম্পানিগুলি ছিল সরকারি বণিক কোম্পানি। তাই কোনাে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিতে গেলে স্পেন-পাের্তুগাল ও ফ্রান্সের বণিক কোম্পানিগুলিকে নিজ নিজ দেশের সরকারি অনুমতি নিতে হত। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি যেহেতু বেসরকারি বণিক কোম্পানি ছিল, তাই এক্ষেত্রে তাকে সরকারি অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হত না। তা ছাড়া সরকার বদলের সাথে সাথে সরকারি নীতি বদল হলে স্পেন-পাের্তুগাল ও ফ্রান্সের বাণিজ্য নীতি বদলে যেত। কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সে ভয় ছিল না। দেশের বা সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভার ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিতে হত না।


[3] সঠিক ঔপনিবেশিক নীতি: আঠারাে শতকের শেষদিক পর্যন্ত ইংল্যান্ড তার উপনিবেশগুলিকে শােষণের ক্ষেত্র বলে মনে করত। উপনিবেশবাসীদের সুখ-সুবিধার প্রতি ইংল্যান্ড পুরােপুরি উদাসীন ছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে এই নীতি বদলাতে থাকে। এই নীতির প্রভাব পড়ে ইংরেজ কোম্পানির ওপরেও, তাই দেখা যায় পাের্তুগিজরা ক্রীতদাস প্রথার সুযােগ নেয় এবং স্পেনীয় শােষণে আজটেক ও ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। এদিকে ইংরেজ বণিক কোম্পানি সুচতুরভাবে নিজের উপনিবেশের অধিবাসীদের একটি অংশে সমর্থন লাভের চেষ্টা চালায়। উপনিবেশবাসীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বা দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাকে আরও সুদৃঢ় করে।


[4] অবাধ বাণিজ্য নীতি: ইংরেজ বণিক কোম্পানি ইউরােপের অন্যান্য বণিক কোম্পানি অপেক্ষা উদারনীতি গ্রহণ করে। সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকায় স্বাধীনভাবে ইংরেজ বণিক কোম্পানি বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে তারা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা ইউরােপের অন্য দেশগুলি স্বাধীনভাবে ও নিজেদের পছন্দ মতাে দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।


[5] আর্থিক সমৃদ্ধি: ইউরােপের মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটার জন্যই মূলত আর্থিক সমৃদ্ধি আসে। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের শিল্পপতি ও বণিক সম্প্রদায় তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি নতুন নতুন উপনিবেশগুলিতে বিনিয়ােগ করে আরও বেশি মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট হয়। অপরদিকে ফ্রান্স, স্পেন ও পাের্তুগাল-এর মতাে দেশগুলির এই ধরনের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ছিল না। নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইংল্যান্ডের শিল্পপতিদের সামনে নতুন নতুন শিল্প সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। এই বৈচিত্র খণ্ডিত শিল্প পণ্যের রপ্তানি ও সেগুলির কাঁচামাল জোগাড়ের জন্য নতুন উপনিবেশ দখলের জন্য যে তাগিদ ইংরেজ বণিকদের মধ্যে ছিল পাের্তুগাল ফ্রান্স স্পেনের বণিকদের মধ্যে তা ছিল না।


[6] ঔপনিবেশিক চরিত্রের পার্থক্য: উপনিবেশগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে শাসন পদ্ধতি সংস্কারের নীতি নেয়। ইংল্যান্ডের এই সরকারি নীতির অনুসরণে ইংরেজ কোম্পানিও তার ঔপনিবেশিক বাণিজ্যনীতির পরিচালনা করে। পাশাপাশি স্পেন ও পাের্তুগালের মতাে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামাে আধা সামন্ত্ৰতান্ত্রিক ছিল না। তাই ইংরেজ‌ কোম্পানির শাসনকাঠামাে অনেক বেশি শক্তিশালি ছিল।


[7] বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির ওপর আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা: বিশ্বের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ ইংরেজ বণিক কোম্পানির অধীনে আসে। এই সমস্ত উপনিবেশগুলিতে একদিকে ছিল খনিজসম্পদের ভাণ্ডার ও অন্যদিকে ছিল কাঁচামালের প্রাচুর্য। তাই এশিয়ায় ভারত, সিংহল, সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার মিশর, কেনিয়া, সুদান নাইজেরিয়া, গােল্ডকোস্ট-সহ বিভিন্ন জায়গাগুলি নিজেদের দখলে এনে শিল্পবাণিজ্য ইংরেজ বণিকরা এগিয়ে যায়। এমনকি তারা উপনিবেশগুলির পরিচালনার খরচের জন্যও ইংল্যান্ডের সরকারের প্রতি নির্ভরশীল ছিল না। এই খরচ উপনিবেশগুলি থেকেই জোগাড় করেন। অপরদিকে স্পেন, পাের্তুগাল, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলি এই খরচের জন্য নিজ নিজ দেশের সরকারের ওপর নির্ভরশীল ছিল।


উপসংহার: উপনিবেশ বিস্তারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে সাহায্য লাভ করায় ইংল্যান্ড ইউরােপের অন্যান্য দেশের থেকে বেশি সফলতা পায়।