পশ্চিমি শক্তিগুলি কর্তৃক এশিয়া মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখাে।

সূচনা: উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ইউরােপীয় দেশগুলি এশিয়ায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ গড়ে তােলার লক্ষ্যে প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়।


এশিয়ায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা

[1] ভারতে উপনিবেশ: ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ইউরােপীয় বণিক গােষ্ঠীগুলিকে প্রলুদ্ধ করে। ফলস্বরূপ একে একে ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসি, পাের্তুগিজ প্রভৃতি ইউরােপীয় বণিকগােষ্ঠীগুলি বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভারতে প্রবেশ করে। পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ, দেওয়ানি লাভ এবং পরবর্তী সময়ে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের মধ্যে দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুদৃঢ় হয়।


[2] দূরপ্রাচ্যে উপনিবেশ


  • চিনে: যােড়শ শতকে সর্বপ্রথম পাের্তুগিজ বণিক সম্প্রদায় দক্ষিণের ম্যাকাও বন্দর দিয়ে চিনে প্রবেশ করে। তাদের অনুসরণ করে একে একে স্পেন, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ বা ফরাসি বণিকরাও চিনে প্রবেশ করে এবং বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। পরবর্তী পর্যায়ে চিনে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। ইউরােপীয় দেশগুলি চিনকে তরমুজের ফালির মতাে টুকরাে করে নিয়ে নিজেদের দখলদারি কায়েম করে।


  • জাপানে: জাপানে সর্বপ্রথম মার্কিন সেনাপতি কমােডাের ম্যাথু পেরি পদার্পণ করেন (১৮৫৪ খ্রি.)। প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে একে একে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাপান পূর্বেকার চুক্তিগুলি বাতিল করে দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চিনের অধীনস্থ কোরিয়া দখল করে জাপান অগ্রসর হলে চিন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫ খ্রি.) বাধে।


[3] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উপনিবেশ


  • সিংহলে: ওলন্দাজ বণিকশক্তি সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু অ্যামিয়েন্সের সন্ধি (১৮০২ খ্রি.)-এর ফলে সিংহল ইংল্যান্ডের অধীনস্থ হয়।


  • মালয়ে: মালয়ে প্রথমে একাংশে পাের্তুগিজরা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু পরে সিঙ্গাপুর-সহ সমগ্র মালয়ের ওপরে পাের্তুগিজরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে মালয় ব্রিটিশ উপনিবেশ হয়ে ওঠে।


  • ব্রহ্নদেশ: প্রথম (১৮২৪ খ্রি.) ও দ্বিতীয় (১৮৫২ খ্রি.) ইঙ্গ ব্ৰহ্নযুদ্ধে জিতে ব্রহ্নদেশের সঙ্গে ইয়ানদাবাে সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশ ব্রহ্নদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের অধীনে আনে। তৃতীয় ইঙ্গ-ব্ৰহ্নযুদ্ধ (১৮৮৫ খ্রি.) জয়ের মাধ্যমে সমগ্র ব্ৰহ্নদেশটি ব্রিটিশ শক্তি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।


  • ইন্দোনেশিয়া: জাভা, সুমাত্রা, বাের্নিয়াে এবং বালি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া (ইস্ট ইন্ডিজ)-তে ওলন্দাজরা প্রথমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ওলন্দাজ বণিকশক্তি জাভা উপনিবেশের দখল নিয়ে প্রথমে সেখানে উপনিবেশ গড়ে তােলে।


  • ইন্দোচিন: অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ইন্দোচিন (কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম নিয়ে গঠিত)-এ ফরাসিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে নিজেদের করদ রাজ্যগুলি হাতছাড়া হওয়ায় চিন ফ্রান্সের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে হেরে গিয়ে চিন ইন্দোচিনের ফরাসি আধিপত্য মেনে নেয়।


[4] মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশ: উনিশ শতকে পারস্যকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ-রুশ দ্বন্দ্ব বাধে। প্রথম দিকে পারস্যে ইংরেজরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, রেলপথ নির্মাণ, শিল্প কারখানা স্থাপন, শুল্ক সংগ্রহ প্রভৃতি সুযােগসুবিধার ব্যবস্থা করে। পরবর্তীকালে এই সমস্ত সুযােগসুবিধাগুলি রাশিয়াও দেওয়ার অঙ্গীকার করে পারস্যবাসীকে নিজের অনুকূলে আনে। পারস্যের শাহ্ রাশিয়ার কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নিয়ে তার আজ্ঞাবহে পরিণত হন। এতে পারস্যবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। ইঙ্গ রুশ কনভেনশন (১৯০৭ খ্রি.) স্বাক্ষরের মাধ্যমে উভয় দেশ মিলিতভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। অতঃপর পারস্যের উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণে ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।


[5] নিকট প্রাচ্যে উপনিবেশ: রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া এই দুই দেশ নিকট প্রাচ্য অর্থাৎ তুরস্কের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন (১৯০৭ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইংল্যান্ডও তুরস্ককে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ খ্রি.)র পর তুরস্কে রুশ অগ্রগতি ব্যাহত হয়।


[6] মধ্য এশিয়ায় উপনিবেশ: প্রথম (১৮৩৯ খ্রি.) ও দ্বিতীয় (১৮৭৪ খ্রি.) ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানে ব্রিটিশ প্রভাব দেখা দিলেও সেখানে রুশ আধিপত্য গড়ে ওঠে। খাইবার গিরিপথ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্তবর্তী কয়েকটি উপজাতীয় এলাকা ইংরেজদের অধিকারে আসে। রাশিয়া তুরস্কের মার্ভ অধিকার করে এবং হিরাটে অভিযান চালিয়ে মধ্য এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি অব্যাহত রাখে।


উপসংহার: উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়, যার পরিনামে ঘটে যায় পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ।