উনবিংশ ও বিংশ শতকের উপনিবেশবাদের ইতিবৃত্ত পর্যালােচনা করাে।

সূচনা: আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মূলত ইউরােপীয় নবজাগরণের পর থেকেই উপনিবেশবাদের উদ্ভব ঘটে।


উপনিবেশবাদের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা

[1] উৎস: উপনিবেশবাদ বা 'Colonialism' শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ 'Colonia' থেকে যার অর্থ হল বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট (Estate)। নৌশক্তিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ড, স্পেন, পাের্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকায় সর্বপ্রথম উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল।


[2] সংজ্ঞা: সাধারণভাবে বলা যায় কোনাে দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে নিজের অধীনস্থ করে নেয় তবে সেই অঞ্চলটিকে বলা হয় বিজয়ী দেশটির উপনিবেশ। Encyclopaedia of Social Sciences গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপনিবেশবাদ হল অন্য দেশের ভৌগােলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করে ধীরে ধীরে সেখানকার অর্থনীতি, রাজনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। অর্থাৎ, উপনিবেশবাদ হল ভৌগােলিক সীমা পেরিয়ে অন্য দেশের ওপর অধিকার স্থাপন, শােষণ, রক্ষণ, অর্জন এবং বিস্তার।


[3] প্রকৃতি: প্রকৃতি বিচারে উপনিবেশবাদের তিনটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়, যথা-সামরিক বা রাজনৈতিক রূপ, অর্থনৈতিক রূপ ও সাংস্কৃতিক রূপ। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, স্পেনীয় নাবিকগণ প্রথমে সম্পদ সংগ্রহ, বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন, ভৌগােলিক আবিষ্কার প্রভৃতি মূল উদ্দেশ্য হলেও ক্রমে নতুন দেশগুলি দখল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এভাবে বিজিত সেইসব দেশগুলি শক্তিশালী এবং বিজয়ী ইউরােপীয় দেশগুলির উপনিবেশে পরিণত হয়।


[4] উপনিবেশ স্থাপনের কারণ


  • বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা: অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা রয়েছে এমন অঞ্চলগুলি নিজেদের দখলে এনে ইউরােপীয় দেশগুলি আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠার উদ্যোগ নেয়। মার্কেন্টাইলবাদ নামে একটি অর্থনৈতিক মতবাদ ইউরােপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পাের্তুগাল-সহ কয়েকটি দেশ বৃহৎ শক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, ফলশ্রুতি হিসেবে উপনিবেশ গড়ে ওঠে।


  • উদ্বৃত্ত মূলধন: পুঁজিবাদী দেশগুলির মূলধনি গােষ্ঠী অধিক মুনাফার জন্য নিজ নিজ দেশের সরকারের ওপর উপনিবেশ দখলের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লব ও ধনতন্ত্রবাদ উপনিবেশবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।


  • পুঁজিবাদের প্রসার: ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ে। দেশে এবং বাইরে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়ােগ শুরু হয়। পুঁজিবাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল আরও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসার ঘটানাে। পুঁজিবাদের এই সুষ্ঠু প্রসারের জন্য উপনিবেশ গঠনের প্রয়ােজনীয়তা বাড়ে।


  • সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা: অনেক সময় দখলিকৃত অঞ্চলটিকে ঠিকমতাে শাসন করার জন্য সেখানকার লােকেদের নিয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। এই সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা উপনিবেশের জন্ম দেয়।


  • আমদানি-রপ্তানি: এক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- [a] কাঁচামাল সংগ্রহ, [b] উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়ােগ এবং [c] উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের বাজার। তবে কোনাে অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন না করেও ব্যাবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পুঁজি বিনিয়ােগ এবং পণ্য বিক্রির বাজার দখলের জন্য অবশ্যই উপনিবেশ দখলের প্রয়ােজন ছিল।


[5] প্রভাব: উপনিবেশবাদের প্রভাবে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক শক্তিগুলি শাসক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, অপরদিকে তেমন স্বাধীন দেশগুলি উপনিবেশের রূপ নেয়। ঠিকমতাে শােষণ আর শাসনের লক্ষ্যে উপনিবেশে ঔপনিবেশিক শক্তি নিজের স্বার্থে নানা ধরনের দমনমূলক আইন প্রবর্তন করে এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধ করে।


[6] উপনিবেশবাদের অবসানের কারণ: বেশ কয়েকটি কারণে উপনিবেশবাদের অবসান ঘটে, যথা-জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদ্ভব, জাতীয়তাবাদী চেতনা, বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব, মার্কিন ও সােভিয়েত ভূমিকা, রাষ্ট্রসংঘের গঠন, নির্জোট আন্দোলন ইত্যাদি।


উপসংহার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিরােধী এই মুক্তিসংগ্রাম চরমে পৌছােলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।