উনবিংশ ও বিংশ শতকের সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত পর্যালােচনা করাে | সাম্রাজ্যবাদের তাৎপর্য লেখাে।

সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা

সংজ্ঞা: সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মত রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় একটি দেশ নিজের স্বার্থে অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশ বা সংকুচিত করে তার ওপর যে প্রভুত্ব বা কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে তা হল সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism)। ভি. আই. লেনিন তার 'Imperialism: The Highest Stage of Capitalism' গ্রন্থে লিখেছেন— "সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের একচেটিয়া পর্যায়।"


চার্লস বেয়ার্ড-এর মতে, সাম্রাজ্যবাদ হল কোনাে একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল এবং তার ওপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা।"


[1] সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য


  • অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ: প্রাচীনকালে রােম বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে এবং পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পাের্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি নৌশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল আমদানি এবং উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে। তাই এককথায় বলা যায় সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক সুবিধালাভ।


  • জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ: একটি দেশ অন্য দেশের ওপর ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্য ঘটিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করে থাকে। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার, অভিভাবকত্বের মানসিকতা আবার অনেক সময় কোনাে দেশের শাসক নিজের শৌর্যবীর্যের প্রমাণ রাখার জন্যও সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতেন। জাতীয় শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টার ফলেও সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটেছে।


  • জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা: অনেক সময় কোনাে দেশ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে নিজ নিজ রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। এই লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ও নৌঘাঁটি স্থাপন করতে থাকে। ফলে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে।


  • জনসংখ্যার সংকুলান: অনেক সময় বর্ধিত জনসংখ্যার পুনর্বাসন ও সংকুলানের লক্ষ্যেও অন্য দেশকে পদানত করা হয়। জার্মানি, জাপান, ইটালি-সহ বেশ কয়েকটি দেশ এই ধরনের অজুহাত দেখিয়ে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছে।


  • ধর্ম ও সভ্যতার আদর্শ প্রচার: সুপ্রাচীন অতীত থেকে ইউরােপীয় জেসুইট এবং খ্রিস্টানগণ খ্রিস্টধর্ম এবং ইউরোপীয় সভ্যতার আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে বহু অজানা দেশে পাড়ি দেয়। পরবর্তীকালে এদের অনুসরণ করে বণিকগােষ্ঠী এবং রাজনৈতিক নেতৃবর্গের প্রচেষ্টায় সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।


[2] সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের বিভিন্ন স্তর


  • প্রাথমিক স্তর: কলম্বাসের ভৌগােলিক অভিযান থেকে শুরু করে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের সপ্তদশবর্ষব্যাপী যুদ্ধ পর্যন্ত সময়কাল হল সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের প্রাথমিক স্তর।


  • দ্বিতীয় স্তর: এই স্তরের সময়কাল আনুমানিক ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।


  • তৃতীয় স্তর: এই স্তরের সময়কাল আনুমানিক ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান কাল পর্যন্ত।


[3] সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন রূপ: নানারূপে সাম্রাজ্যবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকরা তাই সাম্রাজ্যবাদকে সামরিক সাম্রাজ্যবাদ, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদরূপে বিভক্ত করেছেন। এগুলির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে।


সাম্রাজ্যবাদের তাৎপর্য


[1] ইউরােপের দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্রাজ্য গঠনের মধ্যে দিয়ে ইউরােপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়।


[2] আর্থিক শােষণ তথা সুযােগসুবিধা লাভের লক্ষ্য নিয়েই ইউরােপীয় দেশগুলি উপনিবেশগুলি থেকে অর্থ শােষণ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে কাঁচামালের আমদানি ও পণ্যের রপ্তানিই ছিল সাম্রাজ্যবাদের আসল লক্ষ্য।


[3] ইউরােপীয় দেশগুলি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়। এরকমভাবেই দূর প্রাচ্যে সােভিয়েত আগ্রাসন রােধের লক্ষ্যে জাপান অগ্রসর হলে রুশ-জাপান দ্বন্দ্ব বাধে।


[4] পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইউরােপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ইউরােপের সঙ্গে আমেরিকার সামুদ্রিক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে। ফলে ইউরােপের বাণিজ্য আরও সমৃদ্ধ হয়।


[5] দক্ষিণ আমেরিকার সােনা ও রুপাে-সহ বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে সম্পদ আমদানির ফলে ইউরােপের একশ্রেণির বণিকদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ জমা হয়। এভাবে পুঁজিপতি বা ক্যাপিটালিস্ট (Capitalist) শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।