ইউরােপীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করাে।

সূচনা: মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) পর থেকে ভারতে ব্রিটিশ তথা ইউরােপীয় পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। উদ্যোগে ভারতে রেলপথ, বস্তু, চা, কফি, নীল, লৌহ- ইস্পাত, জাহাজ, কয়লা প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে।


ইউরােপীয় উদ্যোগে ভারতে শিল্পের বিকাশ

[1] সুতিবস্ত্র: ইউরােপীয় উদ্যেগে হাওড়ায় বাউড়িয়া কটন মিল (১৮১৮ খ্রি.) নামে কার্পাস বস্ত্রশিল্প কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দুজন ফরাসি পণ্ডিচেরিতে (১৮৩০ খ্রি.) এবং জেমস ল্যান্ডন নামে জনৈক ইংরেজ ব্রোচে (১৮৫৩ খ্রি.) সুতােকাটা কল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বস্ত্রশিল্পে ইউরােপীয়রা ভারতীয় শিল্পপতিদের কাছে প্রতিযােগিতায় পরাজিত হয়।


[2] বাগিচা শিল্প: ইউরােপীয়দের উদ্যোগে চা, কফি, নীল প্রভৃতি বাগিচা শিল্পের প্রসার ঘটে। রবার্ট ব্রুস নামে জনৈক ইংরেজ ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে আসামের জঙ্গলে সর্বপ্রথম চা গাছ আবিস্কার করেন। বেন্টিঙ্ক ই সর্বপ্রথম চায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে একটি চা কমিটি গঠন করেন। 


  • [i] কিছু ইংরেজ বণিক ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে আসাম টি কোম্পানি গঠন করে চা-শিল্পে মূলধন বিনিয়ােগ করে। ক্রমে আসাম, বাংলা, কাছাড়, তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের কাংড়া, দক্ষিণ ভারত ও নীলগিরি অঞ্চলে চা-শিল্প প্রসারলাভ করে। উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতে চা শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন ভারত থেকে ১৩ কোটি ৭০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের চা ক্রয় করে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চা-বাগিচার সংখ্যা ছিল ৩০২।


  • [ii] জনৈক ইউরােপীয় ব্যক্তির মালিকানায় বাংলাদেশে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম কফি চাষ শুরু হয়। ইউরােপীয়দের উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতের মহীশূর ও নীলগিরিতে কফি চাষের প্রসার ঘটে। 


  • [iii] ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা বাংলা ও বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নীলচাষের প্রসার ঘটায়। ভারতে উৎপন্ন নীলের মধ্যে গুণগতমান ও চাহিদার বিচারে বাংলা বিহারের নীল ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে ইংরেজ নীলকররা জমির ওপর মালিকানাস্বত্ব লাভ করে।


[3] পাট: ইউরােপীয় মালিকানায় গঙ্গার দুই তীরে বেশ কিছু পাটকল গড়ে ওঠে। জর্জ অকল্যান্ড রিষড়ায় ভারতের প্রথম পাটকল (১৮৫৫ খ্রি.) স্থাপন করেন। এ ছাড়া ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বরাহনগর এবং ১৮৬০-এর দশকে গৌরীপুর, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে পাটকল স্থাপিত হয়। ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে মােট ২ কোটি ৫ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের পাট বিদেশে রপ্তানি হয়।


[4] রেলপথ: ভারতে রেলপথ নির্মাণে পুঁজি বিনিয়ােগ যথেষ্ট লাভজনক ও নিরাপদ মনে করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এখানে মূলধন বিনিয়ােগ করে। গ্যারান্টি ব্যবস্থার মাধ্যমে রেলপথ নির্মাণ করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। তাদের উদ্যোগে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্রায় ২৫ হাজার মাইল রেলপথ নির্মিত হয়।


[5] লৌহ-ইস্পাত: ইংরেজ শিল্পপতিদের উদ্যোগে বাংলা ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে লৌহ ও ইস্পাত শিল্প গড়ে ওঠে। মাদ্রাজের কাছে। পাের্টোনােভাে-তে প্রথম লৌহ ও ইস্পাত কারখানা (১৮২০ খ্রি.) স্থাপিত হয়। এ ছাড়া ব্রিটিশ উদ্যোগে 'বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস কোম্পানি' (১৮৭০ খ্রি.), 'বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি' (১৮৮৯ খ্রি.) এবং 'ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি' (১৯১৮ খ্রি.) গঠিত হয়। জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহণের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা যথেষ্ট সাফল্য দেখায়।


[6] কয়লা: ইউরােপীয়দের উদ্যোগে ভারতে কয়লা শিল্প গড়ে ওঠে। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে রানিগঞ্জে সর্বপ্রথম কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় কয়লাশিল্পের অধিক বিকাশ ঘটে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শুধু বাংলাতেই ১১৯টি কয়লা উত্তোলক কোম্পানি ছিল এবং সেখানে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করত।


[7] সেচের যন্ত্রপাতি: সিন্ধু, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে সেচের যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য ব্রিটিশরা মূলধন বিনিয়ােগ করে। এসবের বিনিময়ে ইংরেজরা চাষিদের কাছ থেকে উচ্চহারে জলকর আদায় করত।


[8] ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য শিল্প: ভারতে ব্রিটিশদের উদ্যোগে ইঞ্জিনিয়ারিং, কাগজ, চামড়া, পশম, মদ, সিমেন্ট, দেশলাই, কাচ প্রভৃতি শিল্পের কিছু কিছু বিকাশ ঘটে। বালি (১৮৭০ খ্রি.), লক্ষ্ণৌ (১৮৭৯ খ্রি.), টিটাগড় (১৮৮২ খ্রি.) ও রানিগঞ্জ (১৮৮৯ খ্রি.) প্রভৃতি স্থানে কাগজের কল স্থাপিত হয়। সামরিক ও রেলকর্মচারীদের শীতের পােশাক সরবরাহের উদ্দেশ্যে সরকার কানপুর ও ব্যাঙ্গালােরে পশম কারখানা গড়ে তােলে। সেনাবাহিনীর বুট সরবরাহের উদ্দেশ্যে কানপুরে স্থাপিত হয় 'হারনেস অ্যান্ড স্যাডলরি ফ্যাক্টরি (১৮৬০ খ্রি.)। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে ৯১টি রেলওয়ে কারখানা, ১৩টি অস্ত্রাগার, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠে। এ ছাড়া কাচ কারখানা, চাল, ময়দা, অভ্র, কাঠ, সােরা, চামড়া, তুলােবীজ নিষ্কাশন প্রভৃতি যন্ত্রশিল্প গড়ে ওঠে।


উপসংহার: এদেশে লৌহ ইস্পাত, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি শিল্পের বিকাশে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের বিশেষ উৎসাহ ছিল না। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কলকারখানার মােট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৮৮। এই শিল্পোন্নয়নের মূলে নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ পুঁজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।


ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সদর্থক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সুফলগুলি উল্লেখ করাে।


ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের নঞর্থক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের কুফলগুলি উল্লেখ করাে।


ব্রিটিশ শাসনকালে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কী ছিল?