ব্রিটিশ শাসনকালে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

সূচনা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা এদেশের অর্থনীতিকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল। নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য প্রয়ােজনে বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম রেলপথ স্থাপন করেন।


রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য বা কারণ

[1] ডালহৌসির উদ্দেশ্য: লর্ড ডালহৌসি বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যগুলি হল-一


  • [i] ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানাে। 

  • [ii] রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাে। 

  • [iii] দেশে শিল্প পরিকাঠামাে গড়ে তুলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগকে স্বাগত জানানাে। 

  • [iv] দেশের কাঁচামাল বন্দরগুলিতে পৌঁছােনাে। 

  • [v] উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী সহজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌছে দেওয়া প্রভৃতি।


[2] পুঁজি বিনিয়ােগ: শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শিল্পপতিরা বিপুল পরিমাণ পুঁজির মালিক হয়ে ওঠে। তারা এই বিপুল পরিমাণ পুঁজি ভারতের নিরাপদ, লাভজনক ও সুবিধাজনক ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ করে আরও পুঁজি উপার্জন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতে রেলপথ নির্মাণে মূলধন বিনিয়ােগ করা তাদের কাছে যথেষ্ট নিরাপদ ও লাভজনক বলে মনে হয়।


[3] কাঁচামাল রপ্তানি: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে সেখানকার কলকারখানাগুলিতে কাঁচামালের চাহিদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ভারত হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে কাঁচামালের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি থেকে কাঁচামাল বন্দরে পৌঁছানাের জন্য রেলযােগাযােগের প্রয়ােজন দেখা দেয়।


[4] বিলাতি পণ্যের সরবরাহ: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে সেখানকার কলকারখানাগুলিতে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রী। উৎপাদিত হতে থাকে। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এই পণ্য বিক্রির বাজার হিসেবে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারতের অভ্যন্তরে দূরদূরান্তের বাজারগুলিতে এই পণ্য পৌছে দেওয়ার জন্য তারা এদেশে উন্নত রেলযােগাযােগের প্রয়ােজন উপলদ্ধি করে।


[5] রাজনৈতিক প্রয়ােজন: ডালহৌসির আমলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত যােগাযােগ রক্ষা ও সংবাদ আদানপ্রদানের প্রয়ােজন ছিল। এ ছাড়াও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরােধ, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য ও রসদ পৌছে দেওয়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়ােজনের তাগিদে সেই সময় ভারতে রেলপথ স্থাপন অপরিহার্য বলে ব্রিটিশ সরকার মনে করে।


[6] সামরিক প্রয়োজন: বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল না, এমন বহু স্থানেও শুধু সামরিক প্রয়ােজনে রেলপথ স্থাপিত হয়।


[7] দুর্ভিক্ষের মােকাবিলা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্ভিক্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের মানুষের কাছে দ্রুত খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী পৌছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার এদেশে রেলপথ স্থাপন অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় বলে মনে করে।


[8] কর্মসংস্থান: সরকার আশা করে যে, ভারতে রেলপথ স্থাপিত হলে এখানে বহু ইংরেজের কর্মসংস্থানের সুযােগ হবে ও ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের অর্থ লগ্নির যথেষ্ট সুযােগ হবে।


উপসংহার: ভারতীয়দের কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশরা ভারতে রেলপথ স্থাপন করেছিল। সুগত বসু ও আয়েষা জালাল তাঁদের 'Modern South Asia' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ভারতে রেলপথ স্থাপনের কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়েছিল। অধ্যাপক জে. এম. হার্ড 'কেন্ত্রিজ ইকনমিক অব ইন্ডিয়া’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে বলেন যে, রেলপথ স্থাপনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান এখনও সম্ভব না হলেও, এর পিছনে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যই ছিল, সে সম্পর্কে কোনাে সন্দেহ নেই। ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে লর্ড ডালহৌসির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশে সুদক্ষ ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।


ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে বিভিন্ন উদ্যোগে রেলপথের সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সদর্থক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সুফলগুলি উল্লেখ করাে।


ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের নঞর্থক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের কুফলগুলি উল্লেখ করাে।