আধুনিক ইতিহাস রচনার মূল বিষয় ও উপাদানগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও | আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য

সূচনা: একজন ইতিহাসবিদ যে সমস্ত নিয়মনীতি আদর্শ ও পদ্ধতি মেনে তার ইতিহাস রচনা করে থাকেন, তা হল ইতিহাস তত্ত্ব।


আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ

[1] জাতীয়তাবাদ: বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ঐতিহাসিকদের লেখায় জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসগুলিতে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসিবিপ্লব, রুশ বিপ্লব বিভিন্ন ইউরােপীয় রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাসবিদ গােবিননার জোসেফ আর্য জাতির, চার্লস কিংসলি টিউটনিক জাতির, মরিসবার গল জাতির, আর. কিপলিং স্যাক্সন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। ভারতীয় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত তিনখণ্ডে লেখেন প্রাচীন ভারতের সভ্যতার ইতিহাস’, যা হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।


[2] যুক্তিবাদ: আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যুক্তিবাদ। আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের স্থলে আসে যুক্তিবাদ। মানুষ বুঝতে শেখে কোনাে কিছু বিশ্বাস করার আগে তাকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া উচিত। মানুষের এই যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে ঐতিহাসিকগণও যুক্তিভিত্তিক ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হন। যুক্তিবাদী ঐতিহাসিকগণ স্থান-কাল-চরিত্র-নির্বিশেষে যুক্তিবাদের আলােকে তথ্যসূত্রগুলি বিচার করে সেগুলি ইতিহাসে প্রয়ােগ করে থাকেন।


[3] প্রগতির ধারণা: ইতিহাসে ঘটনা ও মূল্যবােধ উভয়ের প্রক্রিয়ার‌ মধ্যে দিয়ে প্রগতির উদ্ভব ঘটে। ইতিহাসে প্রগতির আসল অর্থ হল মানুষের ক্ষমতা ও সম্ভাবনার বিপুল বিস্তার। উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের ধনসম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে প্রগতির ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক গিবন ইতিহাসে প্রগতির ধারণা ব্যাখ্যায় বলেন প্রতিটি যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাসে প্রগতির ধারণায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ।


[4] দৃষ্টবাদ: রােমান্টিক ভাবধারার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব ঘটে দৃষ্টবাদী ইতিহাস দর্শনের। রােমান্টিক পর্বে ইতিহাসে যে সমস্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেগুলি যথেষ্ট তথ্যনির্ভর ছিল না। দৃষ্টবাদী দর্শনের প্রবক্তা অগাস্ট কোৎ সমাজের বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক নিয়মরীতি প্রয়ােগের কথা বলেন। দৃষ্টবাদী পদ্ধতি মেনে ঐতিহাসিককে দুটি কাজ করতে হয়, যথা—ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার ও ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা দান। দৃষ্টবাদী দর্শন দ্বারা ঐতিহাসিক ছােটো ছােটো বিষয়কেন্দ্রিক সমালােচনামূলক ইতিহাস রচনা করে থাকেন।


[5] অবয়ববাদ ও উত্তর অবয়ববাদ: বিশ্বসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভাবনাচিন্ডাগুলিই ধীরে ধীরে অবয়বের রূপ নিয়েছে। অবয়ববাদ হল আসলে প্রথাগত ও আচারগত ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল মানব ইতিহাস। ঐতিহাসিক ধারণায় অবয়বের পরিবর্তন ঘটলে বিষয়বস্তুরও পরিবর্তন ঘটে। অবয়ববাদী সমর্থকরা মনে করেন ইতিহাসে সত্যকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় না, পূর্ণ সত্য সদা অধরা থাকে। বিশ্বজনীনতা, ঐক্য, মুক্তি প্রভৃতির ভিত্তিতে উত্তর-অবয়বাদীরা নিজেদের তত্ত্ব গড়ে তােলেন।


[6] আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা: আধুনিকতা শব্দটি আসলে আপেক্ষিক, কেননা প্রতিটি প্রজন্মের কাছেই নিজের যুগটি আধুনিক বলে মনে হয়। রেনেসাঁস যুগের মানুষেরা নিজ যুগকে আধুনিক আখ্যা দিয়েছিল আবার আজকের যুগকে আমরা আধুনিক যুগ আখ্যা দিই। প্রকৃত অর্থে সব দেশে, সব যুগে আধুনিকতার চরিত্র ও মানদণ্ড আলাদা আলাদা হয়। এই বিচারে ঐতিহাসিককে তার আধুনিকতার স্বরূপ বর্ণনা করতে হয়। আধুনিকতার বিচারে ঐতিহাসিক যাকে সত্য বলে ধরে নেন উত্তর আধুনিকতায় তা আংশিক সত্য বা অতিকথা হিসেবে বিবেচিত হয়।


[7] আপেক্ষিকতাবাদ: ইতিহাসের তথ্যসূত্রগুলি কখনােই চিরসত্য নয়, নতুন যুগে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে তথ্যসূত্রের সত্যতা আপেক্ষিক বলে প্রমাণিত হয়। আপেক্ষিকতাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য, প্রথমটি হল- ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুসন্ধান ; দ্বিতীয়টি হল- বর্তমানের প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী ইতিহাস রচনা। এই মতবাদ অনুযায়ী ইতিহাসে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব, সময়ের গুরুত্ব, ঘটনার পরিণতির গুরুত্ব সবই আপেক্ষিক।


[8] বিজ্ঞানধর্মিতা ও নৈতিকতাবাদ: সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানে যেরকম পরীক্ষা, অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়, ইতিহাসেও একইরকমভাবে বিষয়বস্তু ঘটনার সত্যতার কাছাকাছি পৌঁছােনাের চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসের সঙ্গে নৈতিকতারও সম্বন্ধ রয়েছে। ইতিহাসে নৈতিক মূল্যবােধের কষ্টিপাথরে ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলির বিচার করা হয়।


উপসংহার: আধুনিক ইতিহাস তত্ত্ব বলতে আমরা অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের শেষ দশক সময়কাল পর্যন্ত ইতিহাস চর্চাকে বুঝে থাকি।