নব্যবঙ্গ আন্দালনে ডিরােজিওর ভূমিকা লেখাে | নব্যবঙ্গীয় আন্দোলন ব্যর্থ হয় কী কারণে?

নব্যবঙ্গ আন্দোলন ও ডিরোজিও

মতাদর্শ: জিরােজিও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ, হিউম, লক, ভলতেয়ার, টম পেইন প্রমুখের দর্শন এবং শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের মুক্ত চিন্তা, মুক্তিবাদিতা, আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরূপে তিনি তার ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং যুক্তি ও বিচারের দ্বারা সবকিছু গ্রহণ করার কথা বলেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন অতীত গৌরবের অধিকারী ভারতবর্ষের বর্তমান অধঃপতন আটকাতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য ছোঁয়া। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন—"সত্যের জন্য বাঁচো, অসত্য থেকে মুক্ত হও।"


ডিরােজিয়ানস: ডিরােজিওর ছাত্রমণ্ডলী তথা অনুগামী নব্যবঙ্গ গােষ্ঠীর সদস্যরা ডিরােজিয়ানস্ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন ছিলেন তারাচাদ চক্রবর্তী (১৮০৬-৫৫ খ্রি.), রামগােপাল ঘােষ (১৮১৫-৬৮ খ্রি.), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩ খ্রি.), রেভারেন্ড কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-৮৫ খ্রি.), রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০- ৫৮ খ্রি.), রামতনু লাহিড়ী (১৮১২-৮৭ খ্রি.), রাধানাথ শিকদার (১৮১৩- ৭০ খ্রি.) প্রমুখ।


আদর্শ শিক্ষক: ডিরােজিও মাত্র ১৭ বছর বয়সে (১৮২৬ খ্রি.) হিন্দু কলেজে ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি তার ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বীজ বপন করেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে লিখেছেন—“চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তেমনই তিনিও বালকগিদকে আকর্ষণ করিতেন। এরূপ অদ্ভুত আকর্ষণ, শিক্ষক ছাত্রে এরূপ সম্বন্ধ কেউ কখনও দেখে নাই।”


অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন গঠন: ডিরােজিও তার অনুগামীদের নিয়ে কলকাতার মানিকতলায় শ্রীকৃয় সিংহের বাগানবাড়িতে অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন নামে একটি পাঠচক্র গঠন করেন (১৮২৮ খ্রি.)। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তার ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই সংগঠনটির বিভিন্ন অধিবেশনে সনাতন হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা, অদৃষ্টবাদ, পৌত্তলিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সমালােচনা ও বিতর্ক হত। এথেনিয়াম ছিল এই সংঘের মুখপত্র। অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনকে অনেকেই ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রসঙ্গে 'হিন্দু পেট্রিয়ট' পত্রিকায় লেখা হয়— "অক্সফোর্ড, ব্রেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলি যে ভূমিকা পালন করে, হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনও সেই ভূমিকা পালন করে।"


পত্রিকা প্রকাশন: ডিরােজিও নিজে হেসপেরাস' ও ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরােধিতা করেন। ডিরােজিওর অনুগামীরা একই লক্ষ্যে 'পার্থেনন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও ডিরােজিও ব্যক্তিগত উদ্যোগে 'ক্যালেইডােস্কোপ' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন।


নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ব্যর্থত্যর কারণ


[1] উপযুক্ত কর্মসূচীর অভাব: বৃহত্তর সমাজকে নিজেদের চিন্তায় প্রভাবিত করার মতাে কর্মসূচি ডিরােজিয়ানদের ছিল না। এঁদের অতি উচ্ছাস হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ ও আতঙ্কের সঞ্চার করে। তাই সমাজের প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল কোনাে অংশই এঁদের আচরণ মেনে নেয়নি। ডিরােজিয়ানদের তাই অনেকেই উচ্ছঙ্খল, কালাপাহাড়, সমাজ-বিচ্ছিন্ন উগ্র গােষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়।


[2] অধিক উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ: ডিরােজিয়ানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ অত্যন্ত বেশি ছিল। তাদের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব ছিল। সমাজে দ্রুত প্রতিষ্ঠালাভের তাগিদে এবং রক্ষণশীল গােষ্ঠীর বিরােধিতায় তারা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। অপরিণত বয়সি ডিরােজিয়ানরা তারুণ্যে ও ভাবাবেগে বাংলার সমাজজীবনে আলােড়ন তুললেও স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি।


[3] নগরকেন্দ্রিকতা: নব্যবঙ্গ দলের ক্রিয়াকলাপ কয়েকজন ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।


[4] শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা: দেশের জনসংখ্যার মূল অংশ অর্থাৎ কৃষকশ্রেণির সমস্যা ও তার সমাধানে এঁরা অনাগ্রহী ছিলেন। ফলে কৃষকশ্রেণিও এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে দেশীয় কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটলে শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকার সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিল।


[5] সমাজের অভিজাতদের বিরােধিতা: হিন্দু সমাজের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার কোনাে চেষ্টা না করে, সবকিছু না জেনেই তার বিরােধিতা করার ফলে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ই নব্যবঙ্গীয়দের বিরুদ্ধে চলে যায়। বিশেষত, সমাজের অভিজাত ও রক্ষণশীল গােষ্ঠী জিরােজিয়ানদের তীব্র বিরােধিতা করেন। আসলে সমাজে নানা কুসংস্কার ও সমস্যা নিয়ে তারা যতটা সরব হয়েছিলেন সেগুলি সমাধানের ব্যাপারে ততটাই নীরব ছিলেন।


[6] মুসলিমদের অনাগ্রহ: মুসলিম সমাজের সংস্কার নিয়ে ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর কোনাে চিন্তাভাবনা ছিল না। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। ফলে সমাজের একটা বৃহৎ অংশই এই আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।


[7] ধারাবাহিক নেতৃত্বের অভাব: ডিরােজিওর পর উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর অনেকেই আন্দোলন থেকে সরে আসেন। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যবসায় মনােযােগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃয় মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গােবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টার এবং কিশােরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।