কর্মধারা অনুযায়ী গ্রামীণ বসতির শ্রেণিবিভাগ করাে এবং এদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে | গ্রাম্য বসতির কর্মধারা ব্যাখ্যা করাে।

কর্মধারা অনুযায়ী গ্রামীণ বসতির শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য

বর্তমানে গ্রামীণ অধিবাসীরা নানা পেশায় নিযুক্ত থাকলেও অধিকাংশ লােকই প্রাথমিক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। মানুষের জীবিকার প্রাধান্য অনুযায়ী গ্রামীণ বসতির শ্রেণিবিভাগ করা হয়। কর্মধারার ভিত্তিতে গ্রামীণ বসতিগুলিকে ৯টি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।


[1] কৃষিভিত্তিক গ্রাম : যে গ্রামের অর্থনীতি প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল সেই গ্রামকে কৃষিভিত্তিক গ্রাম বলে।


বৈশিষ্ট্য

  • গ্রামীণ বসতির মানুষের প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ।

  • অনুকূল জলবায়ু ও বিস্তীর্ণ পলিগঠিত উর্বর সমভূমিতে গােষ্ঠীবদ্ধ গ্রামীণ জনবসতি গড়ে ওঠে। এইরূপ পরিবেশে অবস্থিত গ্রামগুলি ঘন সংঘবদ্ধ বা রৈখিক প্রকৃতির হয়।

  • গ্রামীণ বসতির গ্রামগুলি বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রের বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রের মাঝে বহু সংখ্যক বাড়ি, ধর্মীয় স্থান, দোকান, রাস্তাঘাট প্রভৃতি নিয়ে বিন্যস্ত হয়।

  • পার্বত্য অঞ্চলের সংকীর্ণ উপত্যকায় অবস্থিত গ্রামগুলি সাধারণত রৈখিক প্রকৃতির হয়।


উদাহরণ : ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে ও কৃয়মৃত্তিকা অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য জনবসতি গড়ে উঠেছে।


[2] মৎস্য শিকারভিত্তিক গ্রাম : যে গ্রামের অধিবাসীরা মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই গ্রামকে মৎস্য শিকারভিত্তিক গ্রাম বলে।


বৈশিষ্ট্য

  • জীবিকার প্রয়ােজনে মৎস্যজীবীরা সাধারণত বাসগৃহ নির্মাণের জন্য জলভাগের নিকটবর্তী স্থান নির্বাচন করে। সমুদ্র উপকূল, নদী, হ্রদ, অন্যান্য জলাশয় প্রভৃতির কাছে। মৎস্যজীবীরা তাদের ছােটো বড়াে গ্রাম গড়ে তােলে।

  • মৎস্য শিকারের সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে জনবসতি ছােটো ও বড়াে হতে পারে।

  • স্থানীয় ভূপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বসতিগুলি রৈখিক, বৃত্তাকার, অর্ধবৃত্তকার ইত্যাদি প্রকৃতির হতে পারে।

  • সমুদ্র উপকূলে বা নদীর মােহানার কাছাকাছি গ্রামগুলি মৎস্য শিকার বন্দর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।


উদাহরণ : বৈতরণী নদীর মােহানা অংশের নাম ধামরা নদী। এই নদীর বামতীরে গড়ে উঠেছে ধামরা মৎস্য শিকার বন্দর। মেদিনীপুর জেলার কাথির কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরের তীরে জুনপুট একটি মৎস্য শিকারভিত্তিক গ্রাম নামে পরিচিত। ওডিশায় অবস্থিত চিলকার উত্তর উপকূলের বালুগাঁও বহুকাল ধরে ছােটো মৎস্য শিকার গ্রাম নামে পরিচিত ছিল, বর্তমানে তা শহরে উন্নীত হয়েছে।


[3] বনভূমিভিত্তিক গ্রাম : যে গ্রামের মানুষের জীবিকা বনভূমির ওপর নির্ভরশীল, সেই গ্রামকে বনভূমিভিত্তিক গ্রাম বলে।


বৈশিষ্ট্য

  • বনাঞ্চলের মধ্যে বা শেষ সীমায় বনভূমির ওপর নির্ভর করে বনবাসীরা ছােটো ছােটো গ্রাম গড়ে তােলে। বনভূমির মধ্যে সামান্য খােলা জায়গায় অবস্থিত গ্রামগুলি সাধারণত সবুজ গ্রাম নামে পরিচিত।

  • এই প্রকার গ্রামের লােকেদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ হলেও সহায়ক উপজীবিকা হিসেবে বনভূমি থেকে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে।

  • কিছু কিছু সবুজগ্রামের অধিবাসীরা সম্পূর্ণরূপে বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা অরণ্যের কাঠ, মধু, মােম, লাক্ষা ইত্যাদি সংগ্রহ করে।


উদাহরণ : নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডে কাঠ চেরাইকে কেন্দ্র করে প্রধানত বনভূমির শেষভাগে ঘনসন্নিবিষ্ট গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠেছে। নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের অরণ্য মানুষের ব্যবহারের পক্ষে অনুকূল নয়। তাই এইসব অঞ্চলে বসতিগুলি বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে কাঠ, মধু, মােম ইত্যাদি সংগ্রহকে কেন্দ্র করে বনভূমির পশ্চিম প্রান্তে ঘনসন্নিবিষ্ট ছােটো ছােটো জনবসতি গড়ে উঠেছে।


[4] খনিজভিত্তিক গ্রাম : খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিতে খনিগুলিতে কাজ পাওয়ার সুবিধা থাকায় খনিগুলির কাছাকাছি যে ছােটো ছােটো গ্রাম গড়ে ওঠে, তাদের খনিজভিত্তিক গ্রাম বলে।


বৈশিষ্ট্য

  • খনিজভিত্তিক গ্রামগুলির অধিকাংশ অধিবাসীই খনিজ দ্রব্য সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।

  • অনেক সময় বড়াে বড়াে খনিগুলির পাশে খনি শ্রমিকদের বসবাসের জন্য পরিকল্পিত কলােনি বা গ্রাম গড়ে তােলা হয়।


উদাহরণ : ভারতের ছােটোনাগপুর মালভূমির খনিজ উৎপাদক অঞ্চলগুলিতে খনিজভিত্তিক গ্রাম ও পরিকল্পিত কলােনি গড়ে উঠেছে। ওডিশার বােলানি একটি খনিজভিত্তিক গ্রাম এবং সিংভূম জেলার মেঘাতুবুরু একটি পরিকল্পিত খনিজ কলােনি হিসেবে গড়ে উঠেছে।


[5] পশুপালন গ্রাম : পশুপালনের ওপর নির্ভর করে যে গ্রাম গড়ে ওঠে তাকে পশুপালন গ্রাম বলে। পশুপালন গ্রামের অধিবাসীরা প্রধানত পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতে চাষবাসও করে থাকেন। তৃণভূমি, মরুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলে সাধারণত পশুপালন গ্রাম গড়ে ওঠে।


বৈশিষ্ট্য

  • এই ধরনের গ্রামগুলি স্থায়ী, অর্ধস্থায়ী বা অস্থায়ী প্রকৃতির হয়।

  • যেসব অঞ্চলে সারা বছর পশুখাদ্য পাওয়া যায় অথবা তৃণের চাষ করা হয়, সেইসব অঞ্চলে স্থায়ী পশুপালন গ্রাম গড়ে ওঠে।

  • ঋতুনির্ভর তৃণভূমি অঞ্চলে এবং স্বল্প উদ্ভিদযুক্ত মরুভূমি বা মরুপ্রায় অঞ্চলে পশুখাদ্যের সন্ধানে অধিবাসীরা অনবরত বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। তাই তারা অস্থায়ী বসতিতে বাস করে।

  • শীতল ও বন্ধুর পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা যাযাবর বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকে। গ্রীষ্মকালে তারা পশুখাদ্যের সন্ধানে পশুর দল নিয়ে পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত চারণভূমিতে চলে যায় এবং শীতকালে তারা নীচের স্থায়ী বসতিতে ফিরে এসে কৃষিকাজে নিযুক্ত হয়। তাই গ্রীষ্মকালীন বসতিগুলি হয় অস্থায়ী বা অর্ধস্থায়ী এবং ছোটো এবং শীতকালীন বসতিগুলি হয় বড়াে এবং সংঘবন্ধ।


উদাহরণ : পশ্চিম হিমালয়ের গাদ্দি উপজাতি গ্রীষ্মকালে পশুচারণ করে ও অস্থায়ী বসতিতে বাস করে এবং শীতকালে ঋতুভিত্তিক কৃষিকাজ করে ও স্থায়ী বসতিতে বাস করে। অপরদিকে, রাজস্থানের বানজারা গােষ্ঠীর মানুষ সবসময় পশুর পাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে তারা সবসময় অস্থায়ী বসতিতে বাস করে।


[6] পরিসেবা গ্রাম : অনেক সময় কোনাে কোনাে গ্রাম তার নিকটবর্তী বা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির পরিসেবা কেন্দ্রূপে গড়ে ওঠে। এই ধরনের গ্রামে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসেবা প্রদানের জন্য নানারকম প্রতিষ্ঠান লক্ষ করা যায়। যেমন—বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি অফিস, থানা, বাজার প্রভৃতি গড়ে ওঠে।


[7] বাজারভিত্তিক গ্রাম : বাজারভিত্তিক গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একটি দৈনিক বাজার বা সাপ্তাহিক হাট অবস্থান করে যা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। যেসব অঞ্চলে প্রচুর সম্পদ, বিশেষ করে কৃষিসম্পদ উৎপন্ন হয়, তাদের কেন্দ্রস্থলে বাজারভিত্তিক গ্রাম গড়ে ওঠে। এই সমস্ত গ্রাম সাধারণত বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথ বা জলপথ দ্বারা যুক্ত থাকে।


[8] পরিবহণ গ্রাম : যেসব গ্রামের মানুষের অধিকাংশই পরিবহণ-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত, সেইসব গ্রামকে পরিবহণ গ্রাম বলে।


বৈশিষ্ট্য

  • এই ধরনের বসতিগুলি অনেক সময় পরিবহণের কেন্দ্রবূপে অবস্থান করে।

  • পরিবহণ গ্রামগুলি প্রধানত সড়কপথের সংযােগস্থল, রেলস্টেশন বা খেয়াঘাট ইত্যাদির কাছে গড়ে ওঠে।

  • এই ধরনের গ্রামগুলি সাধারণত সেই সমস্ত জায়গায় গড়ে ওঠে যেখান থেকে পণ্যদ্রব্য পরিবহণের এক মাধ্যম থেকে আর এক মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। এই ধরনের অবস্থানগুলি হল—সড়কপথ ও রেলপথের সংযােগস্থল, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও সমভূমির সংযােগস্থল, মরুভূমির সীমান্তবর্তী অঞ্চল, স্থলপথ ও জলপথের সংযােগস্থল ইত্যাদি।

  • নাব্য নদীতে জলপথ পরিবহণ-সংক্রান্ত কাজকর্মের ওপর নির্ভর করে গ্রাম্যবসতি গড়ে উঠতে পারে।


[9] শিল্পভিত্তিক গ্রাম : যেসব গ্রামের অধিবাসীরা নানারকম কুটির শিল্পে বা ক্ষুদ্রশিল্পে নিযুক্ত থেকে জীবিকানির্বাহ করে সেইসব গ্রামকে শিল্পভিত্তিক গ্রাম বলে। ভারতে এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানকার মানুষেরা প্রধানত বস্ত্রবয়নশিল্প, মৃৎশিল্প ও হস্তশিল্পে নিযুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।


উদাহরণ : পশ্চিমবঙ্গের ধনেখালি ও বেগমপুর (তাঁতশিল্প) পাঁচমুড়া (মৃৎশিল্প), কাঞ্চনলতা (ধাতব শিল্প) ইত্যাদি শিল্পভিত্তিক গ্রামের উদাহরণ।


[10] অন্যান্য গ্রাম : এ ছাড়াও গ্রাম্য বসতির আরও বিভিন্ন কার্যাবলি থাকতে পারে। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কোনাে স্থান ভ্ৰমণকেন্দ্ররূপে গড়ে উঠলে গ্রামে বসবাসকারী লােকজন সেই প্রকার কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রসারিত বাণিজ্যপথের ধারে বণিকদের রাত্রিবাসের জন্যও বসতি গড়ে উঠতে পারে। এইরূপ গ্রাম্য বসতিকে ক্যারাভান সরাই বলে।

মামফোর্ডের বয়সভিত্তিক পৌর বসতির শ্রেণিবিভাগ করাে। মহানগর ও মহানগরপুঞ্জের মধ্যে পার্থক্য লেখাে।


পৌর বসতির কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে। অথবা, কর্মধারা অনুযায়ী পৌর বসতির শ্রেণিবিভাগ করাে।


গ্রামীণ জনসংখ্যার উৎক্ষেপ কী? ভারতে গ্রামীণ জনবসতির বণ্টনগত বৈচিত্র্য উল্লেখ করাে।


Geography সব প্রশ্ন উত্তর (দ্বাদশ শ্রেণীর)