পৌর বসতির কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে | কর্মধারা অনুযায়ী পৌর বসতির শ্রেণিবিভাগ করাে।

কর্মধারা অনুযায়ী পৌর বসতির শ্রেণিবিভাগ

পৌর বসতির কার্যাবলি বিভিন্ন প্রকারের। প্রতিটি পৌর বসতিতে কতকগুলি সাধারণ কাজের পাশাপাশি কিছু মুখ্য কাজও সম্পাদিত হয়। মুখ্য কাজগুলির মধ্যে সেগুলির প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। সেগুলিকে পৌর বসতির বৈশিষ্ট্য ধরে শহর বা নগরের শ্রেণিবিভাগ করা হয়।


[1] প্রশাসনিক শহর : প্রশাসনিক কাজকর্মের প্রয়ােজনে সুবিধাজনক স্থানে রাজধানী শহর, জেলা শহর, মহকুমা শহর ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। প্রশাসনিক কাজকর্ম ছাড়াও এখানে ছােটো ছােটো শিল্প ও বাণিজ্য এলাকা গড়ে ওঠে। এই শহরগুলির জনসংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে এবং এ ছাড়া এখানে উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ ও টেলি-যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয় এবং বিচার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।


  • উদাহরণ : নতুন দিল্লি ভারতের জাতীয় রাজধানী শহর, কলকাতা রাজ্যের রাজধানী শহর, হাওড়া ও বাঁকুড়া জেলা শহর প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য প্রশাসনিক শহর।


[2] প্রতিরক্ষা শহর : প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কাজকর্মের ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত শহর গড়ে ওঠে সেগুলিকে প্রতিরক্ষা শহর বলে। এই শহরগুলিতে সেনাবাহিনীর প্রয়ােজনীয় উপকরণ তৈরির কারখানা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা শহরগুলিতে পরিবহণ ব্যবস্থা বেশ উন্নত, সেনাবাহিনীর থাকার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এখানে বিমান অবতরণ ক্ষেত্র ও যুদ্ধজাহাজের জন্য পােতাশ্রয় প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকে।


  • উদাহরণ : পাঁচমাড়ি ও আম্বালা ভারতের প্রতিরক্ষা শহর।


[3] সাংস্কৃতিক শহর : যেসমস্ত শহরের কাজকর্মের মধ্যে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক কাজকর্ম, যেমন-শিক্ষা ও সংস্কৃতিই প্রধান, সেই সমস্ত শহরকে সাংস্কৃতিক শহর বলে। এইসব শহরে বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক ভবন, খেলার মাঠ, পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র, খেলাধুলার সরঞ্জাম, পােশাক পরিচ্ছদের দোকান ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।


  • উদাহরণ : ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ও ভারতের শান্তিনিকেতন সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে বিশেষ পরিচিত।


[4] পণ্যদ্রব্য সংগ্রাম শহর : যে-সমস্ত শহর শিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ, শােধন ও বাণিজ্যের জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করে, সেই সমস্ত শহরকে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ শহর বলে। খনিজ দ্রব্য ও কাঠ সংগ্রহকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের বেশির ভাগ পণ্যদ্রব্য সংগ্রহের শহর গড়ে উঠেছে।


  • উদাহরণ : বিভিন্ন খনিজ উত্তোলক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে খনিজ শহর, যেমন—কয়লা উত্তোলক অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে ধানবাদ ও ঝরিয়া, তামাখনির কাছে সৃষ্টি হয়েছে ঘাটশিলা এবং আকরিক লােহা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মেঘাতুবুরু প্রভৃতি। কানাডা, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও মায়ানমারে কাঠ সংগ্রহ ও পরে তা ব্যবহারের উপযোগী করে তােলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে কাঠ সংগ্রহ শহর। উল্লেখযোগ্য শহরগুলি হল কানাডার কর্নার ব্রুক, মায়ানমারের আকিন প্রভৃতি। খনিজ দ্রব্য ও কাঠ সংগ্রহ ছাড়াও মাছ সংগ্রহকে কেন্দ্র করেও পৃথিবীর বহু জায়গায় শহর সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ভারতের পশ্চিম উপকূলের কোচি ও পূর্ব উপকূলের বালুগাঁও।


[5] পণ্যসমূহের বন্টন শহর : যে-সমস্ত শহর উৎপাদিত বা সংগৃহীত পণ্যসামগ্রী বণ্টনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, সেই সমস্ত শহরকে পণ্যসমূহের বণ্টন শহর বলে।


  • উদাহরণ : টোকিও, লন্ডন, কলকাতা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি এই জাতীয় শহর।


[6] শিল্প শহর : যে-সমস্ত শহরের বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে কাঁচামালকে শিল্পজাত দ্রব্যে রূপান্তরিত করা প্রধান জীবিকা হিসেবে গণ্য হয় সেই সমস্ত শহরকে শিল্প শহর বলে। এইসব শহরে শিল্প স্থাপনের উপযােগী পরিকাঠামাে যেমন—পরিবহণ, বাজার, বিদ্যুৎ শক্তির প্রাচুর্য, শ্রমিকদের বাসস্থান প্রভৃতি থাকে। কোনাে কোনাে শহরে বিশেষ এক ধরনের শিল্প গড়ে ওঠে। আবার, কোনাে কোনাে শহরে একাধিক শিল্পের সমাবেশ ঘটে।


  • উদাহরণ : ভারতের উল্লেখযােগ্য শিল্প শহরগুলি হল- জামশেদপুর, রৌরকেলা, বিশাখাপত্তনম, রাজমুন্দ্রি প্রভৃতি।


[7] পর্যটন শহর : ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক আকর্ষণে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে। এই পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পর্যটন শহর। পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিক সুযােগসুবিধাযুক্ত হােটেল, বাজার প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।


  • উদাহরণ : ভারতের ডালহৌসি, কুলু-মানালি, দার্জিলিং, দিঘা প্রভৃতি হল পর্যটন শহর।


[8] ধর্মীয় শহর : ধর্মীয় কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যে শহর গড়ে উঠেছে তাকে ধর্মীয় শহর বলে।


  • উদাহরণ : ভারতের অমৃতসর, বারাণসী, পুরী ও তিরুপতি, আরবের মক্কা ও মদিনা, ইতালির রােম, তিবৃতের লাসা প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য ধর্মীয় শহর।


[9] আবাসিক শহর : কেবলমাত্র বসবাসের জন্য যে-সমস্ত শহর গড়ে ওঠে, সেগুলিকে আবাসিক শহর বলে। এই সমস্ত শহরে অন্যান্য কার্যাবলি বিশেষ প্রাধান্য পায় না। বড়াে বড়াে শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সাধারণত এই জাতীয় শহর গড়ে ওঠে।

  • উদাহরণ : পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী, বিধাননগর, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের কাম্বারল্যান্ড ও গিল্ডফোর্ড হল বিশেষ বিশেষ আবাসিক শহর।