ওয়েবারের শিল্পস্থানিকতার ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

ওয়েবারের শিল্প স্থানিকতার ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্ব

1909 খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড ওয়েবার 'Uber Den Standort Der Industrien' গ্রন্থে শিল্পের অবস্থান-সংক্রান্ত একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন। পরে 1929 খ্রিস্টাব্দে এই তত্ত্বটিরই ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়, যা 'Weber's Least Cost Theory of Industrial Location' বা 'ওয়েবারের শিল্প-স্থানিকতার ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্ব' নামে পরিচিত।


অনুমানসমূহ


  • শিল্প যেখানে গড়ে উঠবে সেই সম্ভাব্য অলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, জনবসতি এবং মানুষের প্রকৃতি ও দক্ষতা সর্বত্র একইরকমের। অঞ্চলটি একটি শাসনব্যবস্থার অধীন। সমস্ত অঞ্চলটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিযােগিতার অন্তর্গত এবং বাজারে উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা সীমাহীন।


  • কিছু সম্পদ যেমন—জল, বায়ু, সূর্যালােক প্রভৃতি অফুরন্ত এবং সর্বত্রপ্রাপ্য। অন্যদিকে বেশিরভাগ সম্পদ, যেমন খনিজ পদার্থ, শস্য, বনভূমি নির্দিষ্ট স্থানেই কেন্দ্রীভূত।


  • শ্রমিক সর্বত্র সুলভ নয়। শ্রমিকের উৎস, জোগান ও মজুরি প্রভৃতি নির্দিষ্ট।


  • পরিবহণ ব্যয় পণ্যের ওজন ও পণ্য স্থানান্তরের দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল।


তত্ত্বের মূলকথা : ওয়েবারের মতে শিল্প সেখানেই গড়ে উঠবে। যেখানে পরিবহণ ব্যয় ন্যূনতম, মজুরি ব্যয় সর্বনিম্ন এবং বিভিন্ন শিল্পের একত্র সমাবেশের ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা সবচেয়ে বেশি।


  • শিল্পের অবস্থানের ওপর কাঁচামালের প্রভাব : ওয়েবারের মতে, শিল্পের অবস্থানের ওপর কাঁচামালের প্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়। এক্ষেত্রে ওয়েবার চার ধরনের কাঁচামালের কথা বলেছেন (i) সর্বত্রপ্রাপ্য কাঁচামাল (জল, বায়ু, সূর্যালোেক ইত্যাদি) (ii) কেন্দ্রীভূত বা সীমাবদ্ধ কাঁচামাল (খনিজ সম্পদ, শস্য, কাঠ, মাছ প্রভৃতি) (iii) বিশুদ্ধ কাঁচামাল (তুলাে) (iv) অবিশুদ্ধ কাঁচামাল (ইক্ষু, আকরিক লােহা, আকরিক তামা ইত্যাদি)। শিল্পের স্থানিকতার ধরনকে কেন্দ্রীভূত বা সীমাবদ্ধ কাঁচামালগুলি বেশি করে প্রভাবিত করে। ওয়েবারের মতে যে শিল্পের কাঁচামাল বা কাচামালগুলি যত বেশি ওজন হ্রাসমান, সেই শিল্পের তত বেশি সম্ভাবনা হল কাঁচামালের উৎসে বা উৎসের নিকটে গড়ে ওঠার। যেমন—ভারতের লৌহ ইস্পাত শিল্প। আবার বিশুদ্ধ কাঁচামাল নির্ভর শিল্পগুলি শিকড় আলগা প্রকৃতির শিল্প হওয়ায় এগুলি যে-কোনাে স্থানে (কাঁচামালের উৎস অঞ্চলে, বাজারে বা মধ্যবর্তী স্থানে) গড়ে উঠতে পারে। শিল্প স্থানিকতার ওপর কাঁচামালের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে ওয়েবার তাঁর তবে বস্তুসূচক (Material Index) ধারণার অবতারণা করেন।


  • শিল্পের অবস্থানের ওপর পরিবহণ ব্যয়ের প্রভাব : ওয়েবারের মতে, শিল্পে দু-ধরনের পরিবহণ ব্যয় হয়— (i) শিল্প কারখানায় কাঁচামাল আনার ব্যয় (AC) এবং (ii) উৎপাদিত পণ্য বাজারে পাঠানাের ব্যয় (MC)। শিল্পের অবস্থানের ওপর পরিবহণ ব্যয়ের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওয়েবার একাধিক পরিস্থিতির উল্লেখ করেন—


ওয়েবার সমবাহু ত্রিভুজের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, যখন দুটি সমান প্রকৃতির ওজন হ্রাসমান কাঁচামালের প্রয়ােজন হয়, তখন শিল্পটি ওই দুটি কাঁচামালের উৎসের মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে ওঠে। কিন্তু যদি কাঁচামাল দুটি সমহারে ওজন হ্রাসমান না হয় এবং পণ্য উৎপাদনে সমপরিমাণে ব্যবহৃত না হয়, তবে শিল্প কারখানা অপেক্ষাকৃত ভারী এবং অধিক পরিমাণ কাঁচামালের উৎসের নিকট গড়ে উঠবে।


ওয়েবার এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুধরনের সমকেন্দ্রিক পরিবহণ ব্যয় রেখার কথা কল্পনা করেছেন—


  • সমপরিবহণ ব্যয়রেখা বা আইসােটিম : যে রেখার সাহায্যে কাঁচামালের পরিবহণ ব্যয় ও উৎপাদিত পণ্যের পরিবহণ ব্যয়কে পৃথকভাবে বােঝানাে হয়।


  • মােট পরিবহণ ব্যয় রেখা বা আইসােডাপেন : যে রেখার সাহায্যে কাঁচামাল ও উৎপাদিত দ্রব্যের মিলিত বা যৌথ বা মােট পরিবহণ ব্যয় রেখা দেখানাে হয়।


  • শিল্পের অব স্থানের ওপর মজুরি ব্যয়ের প্রভাব : শিল্পের অবস্থানের জন্য ন্যূনতম মজুরি ব্যয় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ওয়েবার তিনটি গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্য নেন— 


(a) মজুরিসূচক: একক প্রতি উৎপাদনের জন্য গড় মজুরিকে মজুরিসূচক বলে। ওয়েবারের মতে, শিল্পের মজুরিসূচক যত বাড়বে, শিল্পের শ্রমিককেন্দ্রিক অবস্থানের ঝোক বা প্রবণতাও তত বাড়বে। 


(b) শ্রমগুণক: কোনাে উৎপাদিত সামগ্রীর একক ওজন প্রতি মজুরি এবং যে পরিমাণ কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য কোনাে শিল্পে পরিবহণ করার প্রয়ােজন হয় তার সম্মিলিত পরিমাণের অনুপাতকে শ্রমগুণক বলে। ওয়েবারের মতে, অনুকূল শ্রমগুণক-যুক্ত স্থানে শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। 


(c) ক্রিটিক্যাল আইসােডাপেন: ব্রিটিক্যাল আইসােডাপেন হল শ্রমিকের মজুরি ব্যয় ও মােট পরিবহণ ব্যয় নির্দেশক কাল্পনিক রেখা। এই আইসােডাপেন বরাবর শ্রমিকের মজুরি ব্যয় ও পরিবহণ ব্যয় ন্যূনতম। সুতরাং যেখানে এটি ন্যূনতম, সেখানে শিল্পস্থাপন করা সবচেয়ে লাভজনক।


  • শিল্পের অবস্থানের ওপর শিল্প সমাবেশের ভূমিকা : ওয়েবারের মতে, শিল্পের অবস্থানে শুধুমাত্র ন্যূনতম পরিবহণ ব্যয়’ বা ন্যূনতম মজুরি প্রভাব বিস্তার করে না। কোনাে জায়গায় একসঙ্গে অনেকগুলি শিল্পের সমাবেশ হলে সেখানে উৎপাদনের খরচ অনেক কম হওয়ায় নতুন শিল্পটি এই শিল্পক্ষেত্রে গড়ে উঠবে।


সমালোচনা : ওয়েবার প্রদত্ত ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্বটিকে ওয়াল্টার আইজার্ড (Walter Isard), মেলভিন গ্রিনহাট (Mevin Greenhut), উইলবার স্মিথ (Wilber Smith) প্রমুখ অর্থনীতিবিদ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচনা করেছেন।


  • ওয়েবার বর্ণিত সর্বত্রলভ্য ও কেন্দ্রীভূত কাঁচামালএই দুপ্রকার বিভাজন অতিসরল ও অবাস্তব। বাস্তবক্ষেত্রে কাঁচামাল একাধিক কেন্দ্রীভূত উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়।


  • ওয়েবার বর্ণিত পণ্যের ওজন ও দূরত্বের ভিত্তিতে নির্ধারিত পরিবহণ ব্যয় পুরােপুরি ঠিক নয় বলে মনে করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবহণ মাধ্যম এবং স্থানান্তরিত পণ্যের প্রকৃতির ওপর পরিবহণ ব্যয় নির্ভরশীল। পরিবহণ ব্যয় দূরত্ব বাড়া বা কমার সঙ্গে সমান হারে বাড়ে বা কমে না, বরং স্বল্প দূরত্বের চেয়ে বেশি দূরত্বে পণ্য পরিবহণ করার খরচ একক প্রতি কম হয়।


  • শিল্প শ্রমিক সহজলভ্য নয়, এরা বিশেষ বিশেষ স্থানে সীমাবদ্ধ। কোনাে স্থানে শ্রমিকের জোগান অসীম এবং শিল্পের ক্রমাগত সমাবেশ সত্ত্বেও সেখানে শ্রমিকের মজুরির হার অপরিবর্তিত থাকবে ওয়েবারের এই ধারণাও অত্যন্ত অবাস্তব।


  • ওয়েবার তাঁর তত্ত্বে ব্রেক অব বাল্ক (Break of Bulk) অবস্থান সম্পর্কে আলােকপাত করেননি। কিন্তু এ ধরনের অবস্থান পরিবহণ ব্যয়ের দিক থেকে সুবিধাজনক।


  • ওয়েবার তাঁর তত্ত্বে শিল্পের অবস্থানের ওপর সামরিক বা প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতি, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, পশ্চাদপদ অঞ্চলের বিকাশ, সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন, বন্দরকেন্দ্রিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ের প্রভাব সম্পর্কে একেবারেই আলােকপাত করেননি।


ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সমস্যাগুলি কী কী? এই সমস্যার সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপগুলি আলােচনা করাে।


ভারত ও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প সম্পর্কে তুলনামূলক আলােচনা করাে।


ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতির কারণগুলি কী কী? ভারতে এই শিল্পের গুরুত্ব আলােচনা করাে।


Geography সব প্রশ্ন উত্তর (দ্বাদশ শ্রেণীর)