মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধাগুলি বিস্তারিত আলােচনা করাে।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ড, লক্ষণ স্বামি মুদালিয়ার নেতৃত্বে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন স্বাধীন ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করে সমস্যার প্রকৃতি, তার গুরুত্ব এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে পূর্ণ মতামত দান করে।

মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

এই কমিশনের বৈশিষ্ট্য হল প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার ত্রুটিগুলিকে খুঁজে বের করে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিটি দিক সম্পর্কে আলােচনা করে সুচিন্তিত মতামত এবং সুপারিশ দান করা। মাধ্যমিক শিক্ষার স্বরূপ কী হওয়া উচিত এবং কী নীতি গ্রহণ করলে এই নতুন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রচলিত হবে তা বিশেষভাবে আলােচনা করা। মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য, মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, ভাষা শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষার নতুন পদ্ধতি, চরিত্র শিক্ষা, বিদ্যালয়ের পরিদর্শন ব্যবস্থা, ছাত্রদের স্বাস্থ্য শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন, শিক্ষকদের উন্নতিবিধান, প্রশাসনিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা সমাধান ইত্যাদি বিষয় গুলোর প্রকৃতি অনুসন্ধান করে বাস্তব জীবনের উপযোগী আদর্শ গুলো তুলে ধরে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত নাগরিক গঠন করাই হল মাধ্যমিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য। আরও বলা হয়, শক্তিশালী ও উচ্চমানের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রচলিত না হলে উচ্চশিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় হতে পারে না।

(১) প্রাথমিক ও উচ্চতর শিক্ষার মধ্যবর্তী হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা।

(২) সুদৃঢ় চরিত্রের অধিকারী ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি করা।

(৩) জীবিকা উপার্জনের উপযোগী যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করে।

(৪) সংস্কৃতি সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।

(৫) উপযুক্ত সৎ নেতা তৈরির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকবে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে।

(৬) সমস্যা সমাধানের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে।

(৭) দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নিতে হবে।

(৮) বয়ঃসন্ধিকালের কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা ও সক্রিয়তার চাহিদাকে স্বীকৃতি দান করাই মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

(৯) শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় গঠন করতে হবে।

(১০) নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়- এই দু-প্রকার বিদ্যালয় প্রচলিত থাকবে। 

মাধ্যমিক শিক্ষার সুবিধা

সুবিধা : উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করতে গিয়ে রাধাকৃয়াণ কমিশন মন্তব্য করেছিল যে, শক্তিশালী ও উচ্চমানের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রচলিত না হলে উচ্চশিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় হতে পারে না। এজন্য সর্বপ্রথমে মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন।

মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরে শিক্ষার দায়িত্ব বহন করে। যাতে শিক্ষার্থীদের জীবনের সার্বিক বিকাশ ঘটানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পালিত হয়।

(১) দেশের সুনাগরিকতার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত হতে পারে। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর এই কাজের সূচনা করতে পারে।

(২) গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রবান নাগরিক তৈরির কাজও করবে মাধ্যমিক শিক্ষা।

(৩) মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, কলা ইত্যাদির সঙ্গে যেমন পরিচিত হবে তেমন তার সংরক্ষণ, সঞলন এবং পুনরুজ্জীবন ঘটানোর সাহায্য করবে।

(৪) দেশে উপযুক্ত নেতার যথেষ্ট অভাব আছে, মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম একটি কাজ হল প্রকৃত নেতা সৃষ্টি করা। যারা দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবে।

(৫) মাধ্যমিক শিক্ষা হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই শিক্ষার সাহায্যে শিক্ষার্থীরা জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবে ও জীবিকা উপার্জনের উপযোগী করে নিজেদের গড়ে তুলবে।

(৬) বৃত্তিমূলক দক্ষতা সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করে। পুথিগত শিক্ষা পরিত্যাগ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃত্তিগত সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে।

(৭) দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে, জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করার মনোভাব জাগাতে হবে।

মাধ্যমিক শিক্ষার অসুবিধা

(১) দেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের প্রয়োজন তার সংস্থান করা হয়নি।

(২) সপ্তপ্রবাহের যে সুপারিশ করা হয় তা মোটেই মনোবিজ্ঞান সম্মত নয়।

(৩) যেসব বিদ্যালয়গুলিতে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক, উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষাগারের অভাব আছে তার সংস্থান কীভাবে হবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

(৪) সাতটি প্রবাহের একটি বেছে নিলে অন্য প্রবাহের বিষয় নির্বাচনের কোনাে সুযােগ থাকে না। এটি সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

(৫) উপযুক্ত বৃত্তি নির্বাচন ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম না হওয়ায় শিক্ষক ও অভিভাবক দ্বারা ভুল নির্বাচন হলে তা শোধরানোর কোনো উপায় থাকে না।

(৬) সপ্ত প্রবাহের আয়োজন গতানুগতিক পদ্ধতি কি বর্জন করতে পারেনি। ফলে সামগ্রিক উন্নতি ঘটেনি।

(৭) গতানুগতিক সংকীর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের চরিত্র এবং ব্যাক্তিস্বত্তার বিকাশ ঘটাতে পারে না। পুথিগত শিক্ষা কখনও প্রয়ােগধর্মীহয় না।

(৮) অত্যাধিক ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার নিয়ম শৃঙ্খলার একান্ত অভাব দেখা যায়।

উপরোক্ত ত্রূটিগুলি ছাড়া শিক্ষকদের উদাসীনতা, গতানুগতিক পাঠক্রম, যান্ত্রিক ও প্রাণহীন শিক্ষার পরিকল্পনা, প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব, অপ্রয়োজনীয় বিষয় পড়ানো ইত্যাদি নানা কারণে আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা এত পিছিয়ে আছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন চরিত্র গঠনের জন্য শিক্ষা বলতে কী বুঝিয়েছে? কমিশন শিক্ষামূলক ও বৃত্তিমূলক নির্দেশনার জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা লেখাে।


শিক্ষকদের জীবিকা মূলক পরিস্থিতি ও তার উন্নয়ন জন্য কমিশন যে সুপারিশ গুলি করেছে তা উল্লেখ করো এবং বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার মূল্যায়ন করাে।


মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশগুলি তত্ত্ব এবং আদর্শগত দিক থেকে আকর্ষণীয় হলেও প্রয়ােগের দিক থেকে ত্রূটিপূর্ণ। —এরুপ বলার কারণ কী?