জ্ঞানদাসের কবিকৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। জ্ঞানদাসকে কেন চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়?

জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলার কারণ

মধ্যযুগের পদাবলীসাহিত্যে তিনটি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়— চণ্ডীদাস জ্ঞানদাস গোবিন্দদাস। চণ্ডীদাস সম্বন্ধে সমস্যার শেষ নেই। কত নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়ে পুরাতন তথ্যকে বাতিল করেছে। গোবিন্দদাসের জীবনকথা অনেকটা জানা যায়। কিন্তু অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকতা জ্ঞানদাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর জীবনী সম্পর্কে অতি অল্প তথ্যই পাওয়া গেছে। কাটোয়ার দশ মাইল পশ্চিমে কাঁদড়া গ্রামে ব্রাহ্মণবংশে তাঁর জন্ম হয়।


তিনি নিত্যানন্দের অনুরাগী ছিলেন এবং নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবীদেবীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। শোনা যায়, তিনি নিত্যানন্দের সাক্ষাৎ লাভ করে ছিলেন। তা যদি সত্য হয় তাহলে তিনি ১৫৩০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি জন্মগ্রহণ করে থাকবেন। তাঁর পদসমূহ পড়ে মনে হয় তিনি নিত্যানন্দের লীলা চাক্ষুষ করেছিলেন। খেতুরী গ্রামে যে বৈষ্ণব সম্মেলন আহুত হয়েছিল সেখানে বলরামদাস, গোবিন্দদাস প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ পদকতাদের সঙ্গে তিনিও উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর ভণিতায় প্রায় চারশ পদ পাওয়া গেছে। পদগুলি পড়ে মনে হয় সকল পদ এক কবির লেখনী-প্রসূত নয়। কিন্তু জ্ঞানদাস দুজন ছিলেন এমন কথা বলবার পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ নেই বলে আপাতত জ্ঞানদাস ভণিতাযুক্ত সমস্ত পদকেই জ্ঞানদাসের রচনা বলে স্বীকার করা হল। অবশ্য এও স্বীকার্য যে জ্ঞানদাসের ভণিতায় এমন কিছু কিছু পদ ও পালাগান পাওয়া গেছে যা জ্ঞানদাসের রচিত হওয়াই সম্ভব।


ভক্তকবি জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি—উভয় ভাষাতেই চমৎকার পদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু ব্রজবুলি অপেক্ষা বাংলা পদগুলিতেই তাঁর প্রতিভা যথার্থ পথ খুঁজে পেয়েছে। সেকালের বৈষ্ণবকবিগণ ব্রজবুলিতে পদ রচনা আবশ্যিক মনে করতেন। জ্ঞানদাসও সেই পথ ধরে ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছিলেন—অনেকটা প্রথা পালনের জন্য। কিন্তু ব্রজবুলির পদগুলিতে কবিপ্রজ্ঞার স্পষ্ট স্বাক্ষর নেই। তাঁর বাংলা পদগুলির সঙ্গে ভাবে ভাষায় যেন চণ্ডীদাসের পদের যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। এখানে তিনি চণ্ডীদাসকে অনুসরণ বা অনুকরণ করেন নি। চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের অন্তর্জীবন ও ভাবকল্পনা অনেকটা এরকম ছিল। এইজন্য তিনি চণ্ডীদাসকে কেবল নকল করেছেন একথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। চৈতন্য বিষয়ক কিছু কিছু পদ তার মন্দ নয়। অবশ্য এই সমস্ত রচনায় কিছু কিছু কৃত্রিমতা আছে তা স্বীকার করতে হবে। তবে জ্ঞানদাস যখন কৃত্রিম কাব্যকলা ছেড়ে সহজ সুরে ও স্বাভাবিক আবেগের বশে রাধাকৃষ্ণ লীলা বর্ণনা করেছেন তখনই তা পাঠকের অন্তর লুঠ করে নিয়েছে, তখনই তিনি চণ্ডীদাসের যথার্থ উত্তরাধিকারী হয়েছেন। এইরূপ ভাব ও ভাষাগত সাদৃশ্যের জন্য চণ্ডীদাসের কিছু কিছু পদ জ্ঞানদাসের ভণিতায় চলে গেছে। অবশ্য উভয়ের মনোধর্মের দিক থেকে কিছু কিছু পার্থক্যও আছে। চণ্ডীদাস ভক্তি আবেগ ও বেদনাকে অবলম্বন করে অনুভূতির যতটা গভীরে অবতরণ করেছেন, জ্ঞানদাস একই পথের পথিক হওয়া সত্ত্বেও ততদূর যেতে পারেন নি। চণ্ডীদাস মূলতঃ ভাবুক ও সাধক, জ্ঞানদাস বৈষ্ণব ভাবরসিক ও সাধক হলেও প্রধানত শিল্পী ও রূপস্রষ্টা। তবে সেই শিল্পচেতনা ও রূপসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিকতার পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে। তাতে কোনও কৃত্রিম কবিসংস্কার নেই। শ্রীরাধা সখীকে তাঁর কৃষ্ণ অনুরাগ সম্বন্ধে বলেন—

শিশুকাল ইতে    বঁধুর সহিতে 

পরাণে পরাণে নেহা। 

না জানি কি লাগি     কো বিহি গঢ়ল 

ভিন ভিন করি দেহা ।। 

সই কিবা সে পিরীতি তার।

জাগিতে ঘুমাতে   নারি পাসরিতে

কি দিয়া শোধিব ধার।।

কিংবা,

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে। 

পরাণ পিরীতি লাগি স্থির নাহি বান্ধে।।

এই পদের ভাব ও ভাষা যেন মধ্যযুগ পার হয়ে আমাদের কালে এসে পৌঁছেছে। তাই কেউ কেউ জ্ঞানদাসের মনোভাব ও রসসৃষ্টির মধ্যে আধুনিক কালের পরিচয় পেয়েছেন। রাধা যখন কৃষ্ণকে বলেন

“তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।”


তখন তা শুধু রাধাকৃষ্ণের কথা না হয়ে নিখিল নরনারীর আত্মসমর্পণমূলক প্রেমের বাণী বহন করে আনে। কবি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে এমন নিবিড় ও মানবিক রসে ভরে তোলবার দুর্লভ শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে এ কালের পাঠক সমস্ত অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনার মধ্যেও মর্ত্যের পরিচিত স্পর্শ খুঁজে পেয়েছেন। বিস্ময়-বিমুগ্ধ রাধা যখন কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন—

তোমার আমার   একই পরাণ

ভালে সে জানিয়ে আমি।

হিয়ার হৈতেবাহির হইয়া

কিরূপে আছিলা তুমি।।


আমি তো জানি তোমার আমার একই প্রাণ; আমার হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তুমি কিরূপে ছিলে? এই প্রশ্ন নিত্যকালের মানবমানবীর প্রশ্ন। জ্ঞানদাসের দুটি চারটি উক্তি অতি চমৎকার শিল্পগুণমণ্ডিত হয়ে সর্বযুগের রসিক পাঠককে আনন্দ দান করবে।


“রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল। 

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।”

এখানে ভাবে-ভাষায়-ইঙ্গিতে যে যৌবনরূপমুগ্ধতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা চণ্ডীদাস ভিন্ন অন্য কোনও পদকর্তা করতে পারতেন কি না সন্দেহ হয়। “ও অঙ্গ পরশে পবন হরষে বরষে পরশ শিলা”—এই সুন্দর উক্তিটির অসামান্য ভাষা ঝংকার প্রথম শ্রেণীর শিল্পী ভিন্ন আর কারও কাছে আশা করা যায় না। একটি অতি বিখ্যাত পদ জ্ঞানদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়

সুখের লাগিয়া   এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয় সাগরে   সিনান করিতে

সকলই গরল ভেল।।


আবার কখনও কখনও চণ্ডীদাসের নামেও এ পদ পাওয়া গেছে। বোধ করি, বাঙালীর সংস্কার এ পদটিকে চণ্ডীদাস রচিত বলে গ্রহণ করতে চাইবে। অবশ্য পদটির ভাব-ভাষা ব্যঞ্জনা—চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের কবিধর্মের সাযুজ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শ্রীরাধার এই নৈরাশ্য যে কোন যুগের যে কোন পাঠকের অস্তরেই সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। এই দিক থেকে জ্ঞানদাস আর চণ্ডীদাসে বিশেষ পার্থক্য নেই। মধ্যযুগের যে কয়েকজন কবির পদ অনুভূতির গভীরে নিয়ে যায় জ্ঞানদাস তাঁদের অন্যতম।