রাঢ়ি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য । রাঢ়ি উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য । ঝাড়খণ্ডি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
রাঢ়ি উপভাষা
রাঢ়ি উপভাষা প্রচলিত অঞ্চলসমূহ: বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়ার পূর্বাংশ, পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মুরশিদাবাদ এবং নদিয়া জেলায় রাঢ়ি উপভাষার প্রচলন রয়েছে।
রাঢ়ি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
‘অ’-এর জায়গায় 'ও'-উচ্চারণের প্রবণতা। সাধারণত ই, উ, ক্ষ এবং য-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী ‘অ'-কার-এর উচ্চারণের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন—অতি > ওতি; অতুল > ওতুল; লক্ষ > লােকখাে; সত্য > শােত্তো।
শব্দের শুরুতে শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের মধ্যে শেষে অবস্থিত মহাপ্রাণ (বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ) ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে (বর্গের প্রথম ও তৃতীয় বর্ণ) পরিণত হয়। যেমন—মধু > মদু; বাঘ > বাগ; বলছি > বলচি; মাঠ > মাট।
অভিশ্রুতির ব্যাপক ব্যবহার এই উপভাষার একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। যেমনকরিয়া > কইর্যা > করে; দেখিয়া > দেইখ্যা > দেখে; বলিয়া > বইল্যা > বলে; আজি > আইজ > আজ।
স্বরসংগতির প্রবণতা এই উপভাষায় লক্ষণীয়। যেমন—বিলাতি > বিলিতি; পূজা > পুজো।
নাসিক্যীভবন এবং স্বতােনাসিক্যীভবনের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন-চন্দ্র > চাঁদ; কণ্টক > কাঁটা; বন্ধ> বাঁধ; বংশ > বাঁশ; পঞ্চ> পাঁচ।
শব্দের শেষে বা মাঝে অবস্থিত অঘােষ ধ্বনি (বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ) কখনাে কখনাে সঘােষ ধ্বনিতে, অর্থাৎ বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন শাক > শাগ; ছাত > ছাদ।
ল-ধ্বনি কখনো কখনাে ন-ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। যেমন লুচি > নুচি; লেপ > নেপ।
রাঢ়ি উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
কর্তৃকারক ছাড়া অন্য কারকের বহুবচনে দের বিভক্তি ব্যবহার করা হয়। যেমন- ছেলেদের; বালকদের; মেয়েদের।
গৌণ কর্মে ‘কে’ বিভক্তি এবং মুখ্য কর্মে শূন্য বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন—দাদা ভাইকে (গৌণ কর্ম) বই (মুখ্য কর্ম) পড়াচ্ছে; মা শিশুকে (গৌণ কর্ম) চাঁদ (মুখ্য কর্ম) দেখাচ্ছে।
অধিকরণ কারকে 'এ' ও 'তে' বিভক্তির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন- ঘরে যাও; বাড়িতে থেকো।
সামান্য অতীত বােঝাতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ক্রিয়াপদে 'ল' বিভক্তি এবং সকর্মক ক্রিয়াপদে 'লে' বিভক্তির প্রয়ােগ। যেমন—সে গেল; সে বইটি দিলে; সে কাজটি করলে।
সামান্য অতীত কালের উত্তম পুরুষে ‘লাম’, ‘লুম’, ‘লেম', 'নু' বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন-আমি করলাম; আমি করলুম; আমি করলেম; আমি করনু।
মূল ধাতুর সঙ্গে আছ যােগে যৌগিক ক্রিয়াপদ গঠিত হয়ে থাকে। যেমন করিতেছি > করছি; করিয়াছি > করেছি।
বিভিন্ন কারকে বিভক্তির জায়গায় অনুসর্গেরব্যবহারও লক্ষ করা যায়। করণ কারকে সঙ্গে, 'সাথে', 'দিয়ে' এবং অপাদান কারকে 'থেকে', 'হতে' প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। যেমন—আমার বােন এখন পেনসিল দিয়ে লেখে; এইমাত্র আমটি গাছ থেকে পড়ল।
ঝাড়খণ্ডি উপভাষা প্রচলিত অঞ্চলসমূহ: পুরুলিয়া; ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশ, যেমন মানভূম, ধলভূম, সিংভূম; পশ্চিম বাঁকুড়া; পশ্চিম মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ঝাড়খণ্ডি উপভাষা প্রচলিত। মনে রাখা দরকার, এই উপভাষার সঙ্গে রাঢ়ি উপভাষার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
ঝাড়খণ্ডি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:
আনুনাসিক স্বরধ্বনির বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন— হাঁতে; উট; চাঁ হইছে; চঁ যাই।
'ও' কারের 'অ'কারে উচ্চারণের প্রবণতা লক্ষণীয়। যেমন- বােকা > বকা; রােগা > রগা; লােক > লক; চোর > চর।
'র' ও 'ন' ধ্বনি অনেকক্ষেত্রে 'ল' ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন- নাতিপুতিরা > লাতিপুতিলা; নয় > লয়।
অপিনিহিতি বা বিপর্যাসের ফলে শব্দের মধ্যে আগত স্বরধ্বনির ক্ষীণ উচ্চারণের রেশ থেকে যায়। যেমন- সন্ধ্যা > সাঁইঝ; কালি > কাইল; রাতি > রাইত।
অল্পপ্রাণ ধ্বনি, মহাপ্রাণ ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। যেমন— আমাকে > হামাক; যাও > ঝাউ; পতাকা > ফত্কা ; দূর > ধূর।
ভাষা কীভাবে ব্যক্তি, পেশা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলাদা রূপ নেয়, তা দেখাও।
জীবিকা মানুষের ভাষার বিশিষ্টতাও তৈরি করে দেয়। এ কারণেই একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সঙ্গে একজন সাধারণ কর্মচারীর, অথবা একজন অফিসারের সঙ্গে একজন শ্রমিকের, একজন শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে একজন সমাজবিরােধীর ভাষার উচ্চারণে এবং শব্দ ব্যবহারে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। প্রত্যেকটি পেশার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের অলক্ষেই ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিক্ষকতার ক্ষেত্রে উচ্চ স্বরাঘাতপূর্ণ, দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বেতার বা দূরদর্শনের ঘােষক-ঘােষিকা বা সঞ্চালক সঞ্জুলিকারা বিশেষ ধরনের এক চিত্তাকর্ষক ভাষায় কথা বলে থাকেন।
সমাজের ইতরশ্রেণি এবং সমাজবিরােধী অর্থাৎ অপরাধীদের ভাষা জীবিকানির্ভর অন্য সমাজভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নিষিদ্ধ জগতের ভাষায় অনেক শ্রেণিভেদও থাকে। গােপন, সাংকেতিক এবং ইঙ্গিতপূর্ণ এই জাতীয় সমাজভাষাকে অপার্থ ভাষা (Cant) বা সংকেতভাষা (Code Language)-ও বলে। বাংলা ভাষায় এইরকম বােমা' অর্থে বড়ােখােকা, হাতবােমা অর্থে ‘আলু’, ‘ডিটেকটিভ পুলিশ’ অর্থে ‘কুকুর’—ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন সমাজবিরােধীরা। যেসব শব্দ শিক্ষিত ভদ্রজনের কাছে নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়, সেইসব শব্দকে বলা হয় ইতর শব্দ (Slang)। যেমন— মাল খাওয়া (মদ্যপান করা), ল্যাং দেওয়া (গােপনে ক্ষতি করা), বাঁশ দেওয়া (ক্ষতি করা) ইত্যাদি।
বাংলাভাষার সামগ্রিক ভাষাবৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলােচনা করাে।
ভাষা বলতে কী বােঝ? কোন্ উপভাষা নিয়ে এবং কেন মান্য চলিত বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে?
মান্যভাষার পরিচয় দিয়ে উপভাষার সঙ্গ মান্যভাষার তুলনা করাে।
লিঙ্গনির্ভর সমাজভাষা সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা করাে।
গ্রাম ও শহরভেদে ভাষার পার্থক্য আলােচনা করাে।
সম্প্রদায়ভেদে ভাষাগত পার্থক্য আলােচনা করাে।
প্রাক-উনিশ শতকের সাধুগদ্যের পরিচয় দাও।
উনিশ ও বিশ শতকের সাধুগদ্যের পরিচয় দাও।
চলিতভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন পর্যালােচনা করাে।
বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক উপভাষা সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ আলােচনা করাে।
উপভাষা-শৃঙ্খল (Dialect Continuum) বলতে কী বােঝ?