বাংলাভাষার সামগ্রিক ভাষাবৈচিত্র্য । মান্যভাষার পরিচয় দিয়ে উপভাষার সঙ্গ মান্যভাষার তুলনা । উপভাষা উৎপত্তির কারণ

বাংলাভাষার সামগ্রিক ভাষাবৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলােচনা

যদি কোনাে ভাষার ভাষিক অঞ্চল বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি তার উপভাষীর সংখ্যাও বেশি হয়, তাহলে বিভিন্ন অঞলে ভাষার রূপের পার্থক্য ঘটে। ভাষার এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে উপভাষা (dialect) বলে। বাংলা ভাষার পাঁচটি উপভাষা দেখা যায়। এগুলি হল—

  • রাঢ়ি,

  • বঙ্গালি,

  • ঝাড়খণ্ডি,

  • বরেন্দ্রী ও

  • কামরূপী।

এর মধ্যে ‘রাঢ়ী’কে 'মান্য চলিত' বলে ধরা হয়।


অঞ্চলের বিভিন্নতার কারণে যেমন উপভাষার জন্ম, তেমনি সামাজিক অবস্থান ও পেশার কারণেও ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শিক্ষিত সমাজের মানুষের ভাষা, অশিক্ষিত শ্রমজীবীদের ভাষার থেকে আলাদা। সামাজিক স্তরভেদে ভাষার এই বৈচিত্র্যকে সমাজভাষা (sociolect) বলে। আবার একই অঞ্চল ও সমাজের মধ্যে থাকা সব মানুষের কথা বলার ধরনও এক হয় না। ব্যক্তিভেদে ভাষার এই বৈচিত্র্যকে ব্যক্তিভাষা (ideolect ) বলে।


উপভাষা, সমাজভাষা ও ব্যক্তিভাষার এই বৈচিত্র্য প্রধানত গড়ে ওঠে কথ্যভাষার উপর নির্ভর করেই। কিন্তু ভাষার আর- একটি রূপ আছে, যাকে লেখ্যরূপ বলা যেতে পারে।


বাংলার ক্ষেত্রে মূলত ক্রিয়া ও সর্বনামের উপর ভিত্তি করে দুটি লেখ্যরূপ প্রচলিত আছে-সাধু ও চলিত। আধুনিক বাংলায় অবশ্য চলিত রূপেরই প্রাধান্য দেখা যায়।


ভাষা বলতে কী বােঝ? কোন্ উপভাষা নিয়ে এবং কেন মান্য চলিত বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে?

ভাষা: ভাষা হল মানুষের পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের একটি ধ্বনিগত মাধ্যম। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রত্যেকটি জনগােষ্ঠীই এই ধ্বনিগত মাধ্যম ব্যবহার করে, কিন্তু প্রত্যেক জনগােষ্ঠীর মধ্যে ধ্বনির বিন্যাস-ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। এই বিন্যাস-ব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্যের জন্যই পৃথিবীতে ভাষার এত বৈচিত্র্য। আর সেই কারণেই সব মানুষ, সব মানুষের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ভাব-বিনিময় করতে পারে না। তার জন্য একজনকে অপরের গােষ্ঠীগত ধ্বনি মাধ্যমটির বিন্যাস-প্রণালী সম্পর্কে অবহিত হতে হয়।


সুতরাং, মানুষের বাগযন্ত্র থেকে উচ্চারিত যে অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টি কোনাে বিশেষ জনসমাজে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হয়, সাধারণভাবে তাকেই ভাষা বলা হয়।


হুগলি নদীর দুই-তীরস্থ অঞ্চলে প্রচলিত রাঢ়ি উপভাষা নিয়েই গঠিত হয়েছে মান্য বাংলা ভাষা। ভাষাগত কারণে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই রাঢ়ি উপভাষার ওই অঞ্চলের রূপটি জন্য বলে চিহ্নিত হয়েছে। শেষ ৩৫ বছর বাদ দিলে ইংরেজদের রাজধানী ছিল কলকাতা। তার আগেই পাের্তুগিজরা হুগলিতে, ফরাসিরা চন্দননগরে এবং ওলন্দাজরা শ্রীরামপুরে আস্তানা গেড়েছিল। ভাগীরথী-হুগলী নদীর তীরেই উনিশ ও বিশ শতকে গড়ে উঠেছিল বিরাট শিল্পাঞ্চল। এসব কারণেই দেশভাগ এবং স্বাধীনতার আগেই আপামর বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল বৃহত্তর কলকাতা। তাই হুগলি নদীর দুই তীরের রাঢ়ি উপভাষাই মান্য চলিত বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে।


উপভাষা কাকে বলে? উৎপত্তির কারণ অনুযায়ী উপভাষাকে কয়ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী? প্রতিটি ভাগের আলােচনা করাে।

কোনো জনগােষ্ঠীর নির্দিষ্ট একটি ভাষার বিভিন্ন রূপভেদকে বলা হয় উপভাষা (dialect)।

উৎপত্তির কারণ অনুযায়ী উপভাষাগুলিকে প্রধানত তিন-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-

  • আঞ্চলিক উপভাষা,

  • সামাজিক উপভাষা ও

  • বিভাষা।


আঞ্চলিক উপভাষা: কোনাে ভাষা যদি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ব্যবহৃত হয় এবং সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যাও যদি বিপুল হয়, তা হলে সেই ভাষার কথ্যরূপ সব জায়গায় একরকম থাকে না। অঞ্চল বিশেষে সেই ভাষার মধ্যে কিছু কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এইরকম আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত কথ্যভাষাকে বলা হয় আঞ্চলিক উপভাষা।


সামাজিক উপভাষা: অঞ্চলভেদ ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি অনুসারে একই ভাষার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ গড়ে উঠতে পারে। শ্রমিকশ্রেণি যে ভাষায় কথা বলে, শিক্ষকশ্রেণির ভাষা তার থেকে আলাদা। অপরাধজগতে এক ধরনের স্বতন্ত্র ভাষার প্রচলন আছে, যা সংকেত ভাষা বা code language নামে পরিচিত। এ ছাড়া পার্থক্য আছে নারী ও পুরুষের ভাষাতেও। এইভাবে সামাজিক নানা স্তরভেদে একই ভাষার যে স্বতন্ত্র রূপ গড়ে ওঠে, তাকে বলা হয় সামাজিক উপভাষা (Social dialect) বা সমাজভাষা (Sociolect)।


বিভাষা বা ব্যক্তিভাষা: একই শ্রেণিতে থাকা এবং একই আঞলিক উপভাষা ব্যবহারকারী এক ব্যক্তির ভাষার সঙ্গে আর এক ব্যক্তির ভাষার প্রভেদ থাকে। মানুষের এই ব্যক্তিগত ভাষা বৈচিত্র্যকেই বলে ব্যক্তিভাষা বা বিভাষা (Ideolect)।


মান্যভাষার পরিচয় দিয়ে উপভাষার সঙ্গ মান্যভাষার তুলনা

মান্যভাষা: কোনাে ভাষার বিশেষ একটি আঞ্চলিক উপভাষা যদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় কোনাে কারণে অন্য উপভাষাগুলি অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পায়, তবে সেই উপভাষাটি পরিণত হয় কেন্দ্রীয় উপভাষায়। এই কেন্দ্রীয় উপভাষায় অন্যান্য উপভাষার কিছু কিছু উপাদান গৃহীত হয় এবং তার একটি সর্বজনমান্য রূপ গড়ে ওঠে। এই ধরনের সর্বজনমান্য উপভাষাকে বলা হয় মান্য কথ্যভাষা বা আদর্শ কথ্যভাষা (Standard colloquial dialect)।


উপভাষার সঙ্গে মান্যভাষা (Standard Language) বা সাহিত্যিক ভাষার (Literary Language) ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাধারাগত কিছু পার্থক্য থাকলেও তাদের পারস্পরিক বােধগম্যতা (Mutual Intelligibility) অক্ষুন্ন থাকে। বাংলা ভাষার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, বাংলা ভাষার আঞ্চলিক উপভাষাগুলির মধ্যে কলকাতা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলের রাঢ়ি উপভাষাকে ভিত্তি করে বাংলার মান্য কথ্যভাষা বা আদর্শ কথ্যভাষা গড়ে উঠেছে। একে মান্য চলিত ভাষারূপেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন উপভাষার অস্তিত্ব থাকলেও সমস্ত অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজ নিজেদের মধ্যে এই মান্য চলিত ভাষায় কথা বলে এবং রেডিয়াে-টেলিভিশনে, বক্তৃতামঞ্চে বা আলােচনাসভায় এই ভাষাই ব্যবহৃত হয়। এই মান্য চলিতভাষা এখন লেখার ভাষা হিসেবেও গৃহীত হয়েছে।


রাঢ়ি উপভাষার প্রচলিত অঞ্চলগুলি লেখাে। এর ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

রাঢ়ি উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

ঝাড়খণ্ডি উপভাষার প্রচলিত অঞ্চলগুলি লেখাে। এর ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

ভাষা কীভাবে ব্যক্তি, পেশা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলাদা রূপ নেয়, তা দেখাও।


লিঙ্গনির্ভর সমাজভাষা সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা করাে।

গ্রাম ও শহরভেদে ভাষার পার্থক্য আলােচনা করাে।

সম্প্রদায়ভেদে ভাষাগত পার্থক্য আলােচনা করাে।

প্রাক-উনিশ শতকের সাধুগদ্যের পরিচয় দাও।


উনিশ ও বিশ শতকের সাধুগদ্যের পরিচয় দাও।

চলিতভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন পর্যালােচনা করাে।

বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক উপভাষা সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ আলােচনা করাে।

উপভাষা-শৃঙ্খল (Dialect Continuum) বলতে কী বােঝ?