যুগােশ্লাভিয়া ও রাশিয়া কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে মনােমালিন্যের কারণ কী ছিল | আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সােভিয়েত রাশিয়া ও পােল্যান্ডের সম্পর্ক লেখাে।

যুগােল্লাভিয়া ও রাশিয়ার মনােমালিন্যের কারণ

[1] যুগোশ্লাভিয়ার স্বাধীন বিদেশনীতি: স্বাধীনােত্তর যুগােশ্লাভিয়াও বিদেশনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সােভিয়েত মডেলকে অনুসরণ করেনি। এর ফলে যুগােশ্লাভিয়া-সােভিয়েত সম্পর্কের অবনতির সূচনা ঘটে। আলবানিয়াতে যুগােশ্লাভিয়ার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। তাই মার্শাল টিটোর যুগােশ্লাভিয়ার সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়।


[2] টিটোর স্বাধীনতাপ্রিয়তা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিনের সঙ্গে যুগােশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর সংঘাত বাধে। এই সংঘাতের মূল কারণ ছিল মার্শাল জোশেফ ব্রোজ টিটোর স্বাধীনতাপ্রিয়তা। তিনি রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের ধারণায় প্রভাবিত হননি। তিনি যুগােশ্লাভিয়ার নেতৃত্বাধীন বলকান ফেডারেশন গঠনে সচেষ্ট হলে স্টালিন ক্ষিপ্ত হন, কেননা স্টালিন মনে করতেন এতে পূর্ব ইউরােপে নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা বাধাপ্রাপ্ত হবে। টিটো যুগােশ্লাভিয়ায় সােভিয়েত রাশিয়ার পুলিশ ও সামরিক কর্মচারীদের ঘনঘন অনুপ্রবেশ মেনে না নিয়ে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালে যুগােশ্লাভিয়া-সােভিয়েত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সােভিয়েত সমালােচক মেডভেদভ-এর মতে যুগােশ্লাভিয়াতে টিটোর উত্তরােত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং স্বাধীন বিচার শক্তি স্টালিনকে ক্রুদ্ধ করেছিল।


[3] পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ: সােভিয়েত নিষেধাজ্ঞা জারি সত্ত্বেও টিটো পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলেন। একটি কমিউনিস্ট দেশ হয়েও যুগােশ্লাভিয়া যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল তাতে সােভিয়েতের সঙ্গে যুগােশ্লাভিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।


[4] ক্রমশ সাম্যবাদে অনাস্থা: যুগােশ্লাভিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতারা বৃহত্তর যুগােশ্লাভিয়া গঠনের পথে সাম্যবাদের বিশ্বায়নকে অন্তরায় বলে মনে করতেন। সাম্যবাদের পথে অনেকটা এগিয়ে চলার পর হঠাৎ সাম্যবাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করায় যুগােশ্লাভিয়ার সঙ্গে সােভিয়েত তথা রাশিয়ার চরম মনােমালিন্য হয়।


[5] মনোমালিন্যের পরিণতি: যুগােশ্লাভিয়া ও রাশিয়ার মনোমালিন্যের কমিউনিস্ট দুনিয়া টিটোর ওপর রুষ্ট হয়। রাশিয়া নানাভাবে তাকে ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু একদিকে সমগ্র যুগােশ্লাভিয়া এবং অন্যদিকে পশ্চিম রাষ্ট্রবর্গের সামরিক ও আর্থিক সাহায্য টিটোকে রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে শক্তি জোগায়। শেষপর্যন্ত টিটোকে বাগে আনতে না পেরে যুগােগ্লাভিয়াকে কমিনফর্ম থেকে বিতাড়িত করা হয় (১৯৪৮ খ্রি., জুন)।


আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়া ও পােল্যান্ডের সম্পর্ক


[1] সম্পর্কের প্রথম পর্ব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পােল্যান্ডে এক সর্বদলীয় যৌথ মন্ত্রীসভা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রকৃত অর্থে পােল্যান্ডে কমিউনিস্টদের প্রভাবই বৃদ্ধি পেয়েছিল। পােল্যান্ডের কমিউনিস্ট নেতা বলেশলাভ বেরাট (Boleslav Beirut)-এর নেতৃত্বে পূর্ব পােল্যান্ডে এক সােভিয়েতপন্থী সরকার গঠিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে এই সরকার পােল্যান্ডের এক বিরাট অংশ রাশিয়াকে প্রদান করে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পােল্যান্ডে একটি নিরঙ্কুশ সাম্যবাদী সরকার গঠিত হয় এবং স্টালিনের পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতাে এই সরকারে কয়েকজন অকমিউনিস্ট মন্ত্রীও নেওয়া হয়। তবে ওইসমস্ত মন্ত্রীর কোনাে ক্ষমতাই ছিল না। এরপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পরিচালনাধীনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে পােল্যান্ডে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সহযােগী দলগুলি জয়লাভ করে এবং পােল্যান্ডে নতুন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সরকারের প্রধান নিযুক্ত হন বলেশলাভ বেরাট।


[2] সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্ব: পােল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হলে স্টালিনের নির্দেশে পােল্যান্ডের উদারপন্থী নেতা গােমুলকাকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয় (১৯৪৮ খ্রি.)। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে গােমুলকাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বেরাটের মৃত্যু হলে পােল্যান্ডে সােভিয়েত বিরােধিতা তীব্র হয়। বিশেষ করে ক্রুশ্চেভের নিস্টালিনিকরণ নীতিতে উৎসাহিত হয়ে পােলিশ গণতন্ত্রীরা গােমুলকাকে নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনার দাবি তােলেন। গণবিদ্রোহ চরমে পৌছােয়। অবশেষে সােভিয়েত পলিটব্যুরাে বাধ্য হয়ে গােমুলকাকে নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনে। কুশ্চেভের নেতৃত্বাধীন এক রুশ প্রতিনিধি দল পােল্যান্ডে আসেন এবং গােমুলকাকে পােলিশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। (১৯৬৮ খ্রি., নভেম্বর)।