পরাধীন ভারতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করাে।

পরাধীন ভারতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রসার

পরাধীন ভারতে বিংশ শতকের প্রথমদিকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রসার শুরু হয়। ভারতের সাম্যবাদী নেতৃবৃন্দ দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। তখন থেকেই ভারতে সমাজতন্ত্রের প্রসার ঘটতে থাকে। বিংশ শতকে ভারতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার সম্পর্কে নীচে উল্লেখ করা হল一


[1] কমিউনিস্ট পার্টি: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সাফল্য সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ভারতীয়দের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরের এক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পার্টির উদ্যোগে ভারতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দ্রুত প্রসার ঘটে। দেশের দরিদ্র, কৃষক ও শ্রমিকদের ওপর কমিউনিস্ট পার্টি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।


[2] কংগ্রেস: স্বাধীনতার আগে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ তরুণ নেতা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সপক্ষে সওয়াল করেন। তাদের প্রভাবে কংগ্রেস দল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তার দলীয় নীতিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আদর্শ গ্রহণ করে। তা ছাড়া কংগ্রেসের বামপন্থী যুবগােষ্ঠীর নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পট্টবর্ধন প্রমুখ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রী দল গঠনের পরিকল্পনা করেন। অবশেষে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইয়ের এক অনুষ্ঠানে 'কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল' প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ।


জওহরলাল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা


জওহরলাল নেহরু লন্ডনে পড়াশােনার সময় (১৯১০-১২ খ্রি.) থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। অবশ্য এই সময় বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থেকে নয়, পুথিগত বিদ্যা থেকে নেহরুর মনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রোথিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর শাসনকালে তিনি ভারতীয় সমাজে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল


[1] সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ: নেহরু মার্কসবাদী শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শে বিশ্বাসী না হলেও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সেখানকার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অতি দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের বিষয়টি তার নজর আকৃষ্ট করে। সাম্যনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাশিয়ার শ্রেণিহীন সমাজের ধারণা নেহরুর সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি মার্কসবাদী চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামােয় সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে দেশের ঐক্য, সংহতি ও সুস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।


[2] মতাদর্শ: প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিদেশি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধাঁচে ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এদেশে সমাজতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। এক কথায়, নেহরুর সমাজতান্ত্রিক ভাবনা ছিল বাস্তববাদী এবং দেশীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই। তার সমাজতান্ত্রিক নীতির মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন নয়, সমাজের অগ্রগতি এবং আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন। ভারতের মতাে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামাের পরিবর্তনের উপায় হল সমাজতন্ত্র।


[3] আবাদী অধিবেশন: পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন যে, সমাজতন্ত্র মানুষের যাবতীয় রােগ দূর করতে সক্ষম। একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দেশ থেকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দুদর্শা দূর করা সম্ভব। তিনি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের আবাদী অধিবেশনে ভারতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নীতি তুলে ধরেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার সমাজতান্ত্রিক কাঠামাের আদর্শ গ্রহণ করে নেয়।


[4] মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি পত্র: নেহরু ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মুখ্যমন্ত্রীদের লিখেছেন যে, "আমরা যখন সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজের কথা বলি, তখন সামাজিক ন্যায়বিচারের কথাই বলি।"