পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা রােধের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে সার্বিক প্রচেষ্টার আলােচনা করাে।

ভূমিকা: মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রথম বিশ্ব, সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিশ্ব, জোটনিরপেক্ষ সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্ব এবং রাষ্ট্রসংঘের মিলিত উদ্যোগে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা রােধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়।


পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রােধের উদ্যোগ


[1] সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ


  • আণবিক শক্তি কমিশন গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার প্রস্তাব অনুসরণে একটি পরমাণু শক্তি কমিশন (Atomic Energy Commission) গঠন করা হয়। এই কমিশন আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ১১ টি সদস্য রাষ্ট্র এবং কানাডা এই কমিশনের সদস্য মনােনীত হয়।


  • জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬০ খ্রি. জেনেভাতে এক নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি তদারকির জন্য ১০টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। দশটি রাষ্ট্র হল রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা, ইটালি, বালগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া ও পােল্যান্ড। এই কমিটি নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে সদর্থক আলােচনার প্রস্তাব রাখে।


  • পরবর্তী সম্মেলনসমূহ: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট মস্কোতে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার নাম আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিরােধক চুক্তি (Partial Nuclear Test Ban Treaty)। এই চুক্তির দ্বারা সমুদ্রগর্ভে, মহাকাশে বা অন্যত্র আণবিক বােমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আর-একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত (১৯৬৬ খ্রি.) হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়—[i] মহাকাশে চাঁদ-সহ অন্যান্য গ্রহে ধ্বংসাত্মক কোনাে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না, [ii] সােভিয়েত বা মার্কিন এই দুই রাষ্ট্রের কেউই মহাকাশে একচেটিয়া কর্তৃত্বের দাবি জানাতে পারবে না। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার উদ্যোগে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ১ জুলাই পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ নিরােধক চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty) স্বাক্ষরিত হয়।


[2] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ


  • বারুচ পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি তথা কূটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচকে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি মনােনীত করেন। বারুচ নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত এক পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করেন (১৯৪৬ খ্রি. ১৫ জুন), যা বারুচ পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এর দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক আণবিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (International Atomic Development Authority বা IADA) গঠন করে পারমাণবিক শক্তির উৎসগুলি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলা হয়।


  • আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার পারমাণবিক দ্রব্য ও কলাকৌশল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক ঘাঁটিগুলির আলােকচিত্র ও ব্ল প্রিন্ট বিনিময়ের উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে এক আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন গঠনের কথা বলেন। রাষ্ট্রসংঘের অনুষ্ঠিত এক সভায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার তাঁর এই শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সােভিয়েত বিরােধিতায় আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।


[3] সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়।


  • সাধারণ সভায় নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব পেশ: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ সভার নিরস্ত্রীকরণ কমিশনের উপসমিতির কাছে এক প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বলা হয়—


    • [i] বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতে খরচের পরিমাণ এক বছরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করতে হবে। 

    • [ii] শর্তহীনভাবে পারমাণবিক বােমা ও হাইড্রোজেন বােমা-সহ সমস্ত ধরনের মারণাস্ত্রের উৎপাদন, মজুতকরণ ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।


  • কুশ্চেভের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী নিকিতা কুশ্চেভ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তােলেন।


  • ব্রেজনেভের উদ্যোগ


    • সল্ট-১ চুক্তি: রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সােভিয়েত ও রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসনের নেতৃত্বে মার্কিন উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সল্ট-১ বা কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি (Strategic Arms Limitation Treaty) স্বাক্ষরিত হয়। এই বৈঠকে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দুটি সমঝােতা পত্র তৈরি হয়। এই সমঝােতা পত্র অনুযায়ী দুই দেশ নিজ নিজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সংখ্যা কমিয়ে আনতে রাজি হয়। সােভিয়েত ও মার্কিন ভূমিনির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM অর্থাৎ Inter-Continental Ballistic Missile) এবং সমুদ্রনির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র (SLBM অর্থাৎ Submarine-Launched Ballistic Missile) উভয়, ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ১৭১০ ও ২৩৫০-এ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তির অন্যতম শর্তে বলা হয়—সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় পক্ষই ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের (ABM বা Anti-Ballistic Missile) দ্বারা নিজেদের রাজধানীসহগুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি রক্ষা করার অধিকার পাবে।


    • সল্ট-২ চুক্তি: সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার ভিয়েনায় এক শীর্ষ বৈঠকে যােগ দেন। এই শীর্ষ বৈঠকে স্বাক্ষরিত দশবছর মেয়াদি ভ্লাদিভস্তক চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের ক্ষেপণাস্ত্র এবং বােমারু বিমানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই চুক্তির শর্তে বলা হয় যে দুই দেশের স্থল এবং সমুদ্র ঘাঁটিতে ২৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র এবং বােমারু বিমান রাখা যাবে না।


  • গরবাচভের উদ্যোগ: পরবর্তীকালে সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গরবাচভ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রােনাল্ড রেগনের সঙ্গে জেনেভাতে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে সফল করার আহবান জানান (১৯৮৫ খ্রি., ১৯ নভেম্বর)। গরবাচভ পরবর্তীকালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন (১৯৯১ খ্রি., ৩১ জুলাই)। এই চুক্তির নাম START-I চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে দুই দেশ ১৬০০ টি Strategic Nuclear Delivery Vehicles এবং ৬ হাজার যুদ্ধ বােমা রাখবার অনুমতি লাভ করে।


  • ইয়েলৎসিনের উদ্যোগ: পরবর্তী রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বরিস ইয়েলৎসিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের সঙ্গে START-II চুক্তি সম্পাদন করেন (১৯৯৩ খ্রি., জানুয়ারি)। এই চুক্তিতে উভয় দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র-ভাণ্ডার অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সম্মত হয়।


হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।


আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল? ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের কারণ সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করাে।


পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ বর্ণনা করাে।