স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলােচনা করাে।

সূচনা: পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে।


স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

[1] সংসদীয় ব্যবস্থা: স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে প্রথমে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের নাগরিকদের গণভােটের ভিত্তিতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিবেচিত হন। এর ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


[2] এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা: ভারতের মতাে বাংলাদেশ আয়তনে সুবৃহৎ নয় বা বহু জাতি ও ভাষাভাষী অধ্যুষিত নয়। ফলে সেদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়ােজন হয়নি। সেখানে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। দেশের রাজধানী ঢাকা হয় প্রধান শাসনকেন্দ্র। এখান থেকে সমগ্র দেশের শাসন পরিচালিত হয়।


[3] রাষ্ট্রপতি: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সংবিধান সংশােধনের পর থেকে বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ শাসক হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে বাস্তবে সেদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রানির মতাে নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি একাদিক্রমে দুই বারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হতে পারেন না। তিনি সরকারি কার্যাবলি বণ্টন ও পরিচালনার জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন।


[4] প্রকৃত শাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান সংশােধনের দ্বারা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রপতি দেশের জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের প্রধান এবং দেশের প্রকৃত শাসক। তিনি ৫ বছরের জন্য এই পদে নির্বাচিত হন। তার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কার্য পরিচালনা করেন।


[5] আইনসভা: বাংলাদেশের পার্লামেন্ট বা আইনসভার নাম হল জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের শাসন পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় আইন প্রণয়ন করে। এক কক্ষবিশিষ্ট এই জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা ৩০০। এই সদস্যরা ন্যূনতম ১৮ বছরের নাগরিকদের সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।


[6] বহুদলীয় ব্যবস্থা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামােয় বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বহু দলের অস্তিত্ব থাকলেও সেদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হল দুটি বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ এবং বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল বা বি. এন. পি. (BNP)। এ ছাড়া প্রাক্তন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পাটিও বাংলাদেশের একটি উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক দল।


[7] বিচার বিভাগ: সুপ্রিম কোর্ট হল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ােগ করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়ােগ করেন। বিচারপতিগণ ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন। সুপ্রিম কোর্টের নিম্নস্তরে হাইকোর্ট ও অন্যান্য নিম্নস্তরের আদালত রয়েছে।


[8] স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলিক অধিকার: 

  • [i] আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। 

  • [ii] সরকারি পদে নিয়ােগে সমান সুযােগ। 

  • [iii] আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার। 

  • [iv] জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ। 

  • [v] গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ। 

  • [vi] জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধিকরণ। 

  • [vii] স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার। 

  • [viii] সমাবেশের অধিকার। 

  • [ix] সংগঠনের অধিকার। 

  • [x] বাকস্বাধীনতা। 

  • [xi] ধর্মীয় স্বাধীনতা। 

  • [xii] সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি।


উপসংহার: বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দান করেন এবং বাংলাদেশকে একটি 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র' হিসেবে ঘােষণা করেন।