স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে।

সূচনা: স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে ভারতের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। ৪৪৪টি ধারা, ১২টি তপশিল এবং ৯৭টি সংশােধন নিয়ে ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংবিধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতবর্ষকে একটি 'সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' বলে ঘােষণা করা হয়।


স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

[1] গণতান্ত্রিক কাঠামাে: স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তিনটি গণতান্ত্রিক আদর্শ-সুবিচার, স্বাধীনতা এবং সাম্য স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য প্রথম থেকে আজও অটুট রয়েছে ও বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।


[2] ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানে ভারতবর্ষকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান কোনাে বিশেষ ধর্মকে অগ্রাধিকার বা রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। প্রতিটি ভারতীয় নিজেদের ইচ্ছানুসারে যে-কোনাে ধর্ম বা ধর্মচারণের অধিকার ভােগ করে থাকে।


[3] মিশ্র কাঠামাে: ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক কাঠামাের অনুসরণে ভারতে মিশ্র রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠেছে। যেমন—ব্রিটেনের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স-এর অনুসরণে ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লােকসভার সৃষ্টি হয়েছে। আবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামাে গড়ে তােলা হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ২৯টি অঙ্গরাজ্য ও ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে।


[4] নির্বাচন ব্যবস্থা: স্বাধীন ভারতে নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুকুমার সেনের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের পরিচালনায় ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লােকসভার ৪৮৯টি এবং রাজ্য বিধানসভার ৩২৮৩টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ২১ বছর ও তার বেশি বয়সের ১৭ কোটি ৩০ লক্ষ ভারতীয় ভােটদাতা অংশগ্রহণ করে। এই সময় থেকে কেন্দ্রে লােকসভা নির্বাচনে এবং রাজ্যগুলিতে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে রাজনৈতিক দলগুলি ৫ বছরের জন্য শাসনক্ষমতা দখল করে।


[5] বহুদলীয় ব্যবস্থা: ভারতে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে ১৪টি জাতীয় দল, ৬৩টি আঞ্চলিক দল এবং বহু নির্দল প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশ নেয়। বর্তমানে জাতীয় কংগ্রেস, বি.জে.পি., সি.পি.আই. (এম.), তৃণমূল কংগ্রেস প্রভৃতি জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও ভারতে বহু আঞ্চলিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে সবচেয়ে বেশিদিন কেন্দ্রে সরকার পরিচালনা করেছে জাতীয় কংগ্রেস দল। সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রে সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।


[6] নিয়মতান্ত্রিক ও প্রকৃত শাসক: সংবিধান অনুসারে, রাষ্ট্রপতি হলেন ভারতের প্রধান শাসক। তবে বাস্তবে তিনি হলেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রানির মতাে নামসর্বস্ব বা নিয়মতান্ত্রিক শাসক। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে দেশ শাসন করেন। ভারতের প্রকৃত শাসক হলেন। প্রধানমন্ত্রী। ভারতের রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লােকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগ করেন।


[7] কেন্দ্রীয় আইনসভা: ভারতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্ট গড়ে উঠেছে। এর নিম্নকক্ষের নাম লােকসভা এবং উচ্চকক্ষের নাম রাজ্যসভা। ভারতে বর্তমানে লােকসভার সদস্য সংখ্যা হল ৫৫২ জন। লােকসভার মেয়াদ হল ৫ বছর। সংবিধান অনুসারে, রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা হয় ২৫০ জন। এদের মধ্যে ১২ জন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত এবং বাকি সদস্যরা বিধানসভার সদস্যদের দ্বারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন। রাজ্যসভার সদস্যরা ৬ বছর স্বপদে বহাল থাকতে পারেন।


[8] বিচার বিভাগ: ভারতের সর্বোচ্চ আদালত হল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টে প্রধানমন্ত্রী-সহ মােট ২৬ জন বিচারপতি থাকতে পারেন। বিচারপতিগণ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতির দ্বারা নিযুক্ত হন। বিচারপতিগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকতে পারেন।


উপসংহার: একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, প্রতিবেশী অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনেকটাই সফল।