স্বাধীন ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বিবরণ দাও।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি.)

সূচনা: ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু (কার্যকাল: ১৯৪৭-৬৪ খ্রি.)-এর উদ্যোগে ভারতে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হল সুসংহত ও সুপরিকল্পিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিশেষ। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতেও বিভিন্ন পঞ্ডবার্ষিকী পরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং তা বর্তমানকালেও চালু আছে।


[1] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য:


  • [i] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের প্রভাবে ভারতের ভেঙে পড়া অর্থনীতি মজবুত করে তােলা। 

  • [ii] দেশের মুদ্রাস্ফীতি দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। 

  • [iii] উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা। 

  • [iv] রাস্তাঘাট তৈরি, সেচের প্রসার, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দ্রুততর করা। 

  • [v] খাদ্য ও কাঁচামালের সংকট দূর করা। 

  • [vi] ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানােন্নয়ন ঘটানাে।


[2] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পদক্ষেপ:


  • [i] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বিভিন্ন উদ্যোগগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যয় ধরা হয় ২,০৬৯ কোটি টাকা। পরে বাড়িয়ে ২,৩৭৮ কোটি টাকা করা হয়। এই অর্থ ভারতীয় শিল্পের অগ্রগতি, শক্তি উৎপাদন, কৃষির প্রসার, পরিবহণ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, সমাজসেবা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


  • [ii] সেচের প্রসার ঘটাতে মেত্তুর, হিরাকুদ ও ভাকরা বাঁধ নির্মাণ শুরু করা হয়।


[3] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য:


  • [i] ১৯৫০-৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের জাতীয় আয় ছিল ৮৮৫০ কোটি টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদের শেষে (১৯৬৫ খ্রি.) এই আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০,৪৮০ কোটি টাকা, অর্থাৎ এই পরিকল্পনায় দেশের জাতীয় আয় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।


  • [ii] ১৯৫০- ৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ২৪৬.৩ টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদের শেষে (১৯৬৫ খ্রি.) এই আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৭৩.৬ টাকা, অর্থাৎ এই পরিকল্পনায় দেশের মাথাপিছু আয় ১০.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।


  • [iii] দেশের কৃষি উৎপাদন ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ৬১৬ লক্ষ টন অতিক্রম করে ৬৫০ লক্ষ টন হয়। ২৩ লক্ষ একর পতিত জমি চাষের আওতায় আসে।


  • [iv] শক্তি ও শিল্পোৎপাদন ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ইঞ্জিনিয়ারিং, শিল্পজাত দ্রব্য, সিমেন্ট, ভারী রাসায়নিক দ্রব্য প্রভৃতির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। ৩৭০ মাইল নতুন রেলপথ নির্মিত হয়।


[4] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রূটি:


  • [i] এই পরিকল্পনায় ২,৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও পুরাে টাকা কাজে লাগানাে যায়নি। বাস্তবে ব্যয় হয়। ১,৯৬০ কোটি টাকা।


  • [ii] কৃষির উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করায় স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পগুলি উপেক্ষিত হয়। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।


  • [iii] কৃষির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ হয়নি।


[5] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্ব:


  • [1] এই পরিকল্পনার ফলে ভারতের জাতীয় আয় ১৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১০.৮ শতাংশ, কৃষি উৎপাদন ২২ শতাংশ এবং শিল্প উৎপাদন ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। 

  • [2] সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতিও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। 

  • [3] এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলা স্থিতাবস্থার অবসান ঘটে। 

  • [4] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথচলা শুরু হয়। 

  • [5] এই পরিকল্পনার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়।