ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসারে ইঙ্গ-শিখ দ্বন্দ্বের পরিচয় দাও।

রণজিৎ সিংহের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক

[1] সম্পর্কের সূচনা: রণজিৎ সিংহ শিখ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি ব্রিটিশের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলে শিখ শক্তির অগ্রগতিতে সচেষ্ট থাকেন এবং অমৃতসর দখল (১৮০২ খ্রি.) করার পর শতদ্রু নদীর পশ্চিমতীরের শিখ মিস্লগুলি একে একে দখল করেন। রণজিতের এই অগ্রগতিতে ভীত হয়ে ইংরেজশক্তি ইউসুফ আলিকে লাহােরে রণজিৎ সিংহের দরবারে পাঠিয়ে সম্মান জানান।


[2] সম্পর্কের অগ্রগতি


  • মিন্টোর সময়কালে অমৃতসরের সন্ধি: রণজিৎ সিংহ প্রথমেই লুধিয়ানা দখল করেন। শিখশক্তির অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টো রণজিৎ সিংহের সঙ্গে দৌত্য স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বড়ােলাট মিন্টোর দূত হিসেবে চার্লস মেটকাফ লাহােরে রণজিৎ সিংহের দরবারে আসেন ও রণজিৎ সিংহের সঙ্গে অমৃতসরের সন্ধি (১৮০৯ খ্রি.) স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা ইংরেজ বিনা যুদ্ধে শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী শিখ রাজ্যগুলির ওপর আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়।


  • ময়রার সময়কালে: অমৃতসরের সন্ধির পর রণজিৎ একে একে কাংড়া (১৮১১ খ্রি.), আর্কট (১৮১৩ খ্রি.), কোহিনুর (১৮১৪ খ্রি.), মুলতান (১৮১৮ খ্রি.), কাশ্মীর (১৮১৯ খ্রি.), পেশােয়ার (১৮২৩ খ্রি.) দখল করে শিখ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।


  • আমহাস্টের সময়কালে: আমহাস্টের আমলে উভয়পক্ষে কূটনৈতিক পর্যায়ে দূত আদানপ্রদান হয়। এসময়ে ইংরেজদের সঙ্গে রণজিতের নেতৃত্বে শিখ শক্তির সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।


  • বেন্টিঙ্কের সময়কালে: রণজিতের সাহায্যলাভের জন্য উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক নিজে লাহােরে আসেন। বেন্টিঙ্ক ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় চিরস্থায়ী মিত্রতা চুক্তি (১৮৩১ খ্রি.)।


  • অকল্যান্ডের সময়কালে: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্নর-জেনারেল অকল্যান্ড আফগানিস্তানে রুশ হস্তক্ষেপের সম্ভাবনায় বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি আফগান অধিপতি শাহসুজাকে কাবুলের সিংহাসনে বসানাের সিদ্ধান্ত নেন। এই লক্ষ্যে বড়ােলাট অকল্যান্ড, শাহসুজা ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি (১৮৩৮ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।


[3] ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের সম্পর্কের অবসান: এর পরেই ইংরেজ বাহিনী কাবুল অভিযান শুরু করে। রণজিৎ এই অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ চলাকালীন (১৮৩৯ খ্রি.) রণজিতের মৃত্যু ঘটলে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কেরও অবসান ঘটে।


ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ


প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ


  • প্রেক্ষাপট: রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর শিখ রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে গােলযােগ বাধে। শিখদের রাজমাতা ঝিন্দন খালসা-বিরােধী মনােভাব দেখান। এই সুযােগে ইংজের পাঞ্জাব দখলের প্রস্তুতি শুরু করেন।


  • যুদ্ধের সূচনা: রাজমাতা ঝিন্দনের প্ররােচনায় শিখ বাহিনী শতদ্রুর ওপারের ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করে। বড়ােলাট হার্ডিঞ্জ অমৃতসরের সন্ধি ভঙ্গের অভিযােগ এনে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ।


  • সন্ধি: যুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রিটিশ সেনাদল লাহােরের দখল নেয়। ফলে শিখরা ইংরেজদের সঙ্গে পরপর লাহােরের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় (১৮৪৬ খ্রি.)।


দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ


  • প্রেক্ষাপট: শিখরা অপমানজনক লাহােরের সন্ধি দুটি মেনে নিতে পারেনি। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিখরা পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়।


  • যুদ্ধের সূচনা: বিক্ষুদ্ধ শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মহম্মদ জোট বাঁধলে শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ।

  • ইংরেজদের পাঞ্জাব জয়: দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ জয়ের পর ডালহৌসি এক ঘােষণার দ্বারা পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন (১৮৪৯ খ্রি.)। পাঞ্জাব জয় করার ফলে ভারতে ইংরেজ কোম্পানির সাম্রাজ্যসীমা আফগানিস্তান পর্যন্ত প্রসারিত হয়।


শিখ শক্তির পতনের কারণ


  • যােগ্য নেতৃত্বের অভাব: দক্ষ ও যােগ্য নেতৃত্বের অভাবের জন্যই শিখ সামরিক শক্তি বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত হলে শিখ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিনষ্ট হয়।


  • আদর্শ বিচ্যুতি: রণজিৎ সিংহ এবং তার পরবর্তী সময়েও সর্বশিখবাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি অখণ্ড শিখ সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে।


  • খালসা বাহিনীর দায়িত্ব: লাহাের দরবারের শিখ সর্দারগণ কূটনীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় খালসা বাহিনী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ শিখশক্তির পতনকে সম্পূর্ণ করে।


উপসংহার: ইঙ্গ-শিখ দ্বন্দ্বে জয়ী হলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি অনেক দৃঢ় হয়।