ভারতীয় সমাজে 'সময়' ও 'মজুরির জন্য শ্রম' সম্পর্কে পশ্চিমি ধারণার কীরূপ প্রভাব পড়েছিল?

সূচনা: পাশ্চাত্যের অনুকরণে এদেশে স্কুলকলেজ, হাসপাতাল, অফিস আদালতে যাতায়াতকারী ছাত্র, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, করণিক ও অন্যান্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে পাশ্চাত্যের সময় ও ‘মজুরির জন্য শ্রম’-এর ধারণা গড়ে ওঠে এবং এ বিষয়ে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।


ভারতীয় সমাজে পশ্চিমি 'সময়'-এর ধরণার প্রভাব

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ পশ্চিমি 'সময়'-এর ধারণা প্রথম গ্রহণ করে। পরে তা ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়। ভারতে পাশ্চাত্যের সময়ের ধারণা প্রচলিত হওয়ার কয়েকটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। এই পর্যায়গুলি হল


[1] প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়-এর ধারণা: পাশ্চাত্য ধাঁচে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজের সময়ও এদেশে বাধা ছিল না। কৃষক, মজুর ও শ্রমিকরা সূর্যোদয়ের পর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। কাজ থেকে ফেরার সুনির্দিষ্ট কোনাে সময় থাকত না। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত বা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বিকেলের পরেও তাদের কাজ করতে হত। দিনের বেলায় অনেকটা অনুমানের দ্বারা আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে কৃষক ও শ্রমিকদের কাজের শুরু ও শেষ হত।


[2] ঔপনিবেশিক আমলে সময়ের ধারণা: অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকে ইউরােপের ঘড়ির ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং সেখানকার অফিস-আদালতের সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করার অভ্যেস চালু হয়। এই সময় ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে ব্রিটিশদের অনুকরণে এদেশে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে পাশ্চাতে্যের সময়-এর ধারণা প্রচলিত হয় এবং সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজের সময় চালু হয়। অফিস-আদালতের অনুকরণে ক্রমে ভারতের কলকারখানাগুলিতেও পশ্চিমি ধাঁচে সময়সূচি চালু হয়।


[3] ঘড়ির ব্যবহার: পাশ্চাত্যের ধাচে ভারতে ঘড়ির সময় ধরে কাজ শুরু হয়। পাশ্চাত্যের সময় কাঠামাের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিনের কার্যাবলি চালাতে গিয়ে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সরকারি চাকুরে, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঘড়ির ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


ভারতীয় সমাজে পন্টিমি 'মজুরির জন্য শ্রম'-এর ধারণার প্রভাব


[1] প্রাক-ব্রিটিশ মজুরি প্রথা: প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ভারতের গরিব চাষি ও মজুররা শ্রমদানের বিনিময়ে নানা উপায়ে মজুরি পেত, যেমন— 


  • [i] কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে শ্রমদাতারা প্রভুর জমিতে বিনা মজুরিতে কাজ করত। বিনিময়ে তারা নিজের চাষের জন্য প্রভুর কাছ থেকে একখণ্ড জমি পেত। 

  • [ii] ঋণের অর্থ পরিশােধে ব্যর্থ হয়েও কেউ কেউ প্রভুর জমি বা খামারে বিনা মজুরিতে কাজ করে ঋণ শােধ করত। 

  • [iii] অনেক সময় শ্রমদানের বিনিময়ে শ্রমদাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রভুর কাছ থেকে নিজেদের প্রয়ােজনীয় অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান পেত।


[2] ব্রিটিশ ধাঁচের মজুরি প্রথা: ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ শাসকরা এদেশে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতগুলিতে মাসিক বেতনদান শুরু করে। ইংরেজদের শিল্প-কারখানা, নীলচাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মজুরদের দৈনিক মজুরি দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এর ফলে ইংরেজদের অনুকরণে ভারতে শ্রমের বিনিময়ে মজুরি দানের প্রথা প্রচলিত হয়।


[3] স্বল্প মজুরি: ব্রিটিশ কারিগর, শ্রমিক ও কর্মচারীরা যে হারে মজুরি পেত ভারতীয় শ্রমিকরা এর চেয়ে যথেষ্ট কম মজুরি পেত। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের সঙ্গে ভারতীয়দের যুক্ত করা হত। শেষপর্যন্ত ভারতীয় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে সরকার ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মজুরি আইন পাস করে।


উপসংহার: অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে এদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটলেও আধুনিক পশ্চিমি ধারণা এদেশে প্রসারলাভ করতে শুরু করে উনবিংশ শতক থেকে। সময় সম্পর্কে পশ্চিমি ধারণা প্রধানত 'মধ্যবিত্ত শ্রেণি’নামে পরিচিত আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ক্ষুদ্র অংশের ভারতীয়দের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভারতের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী এই ধারণা থেকে দূরে ছিল। 'মজুরির জন্য শ্রম' এর ক্ষেত্রে সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও দেশের বিপুল সংখ্যক অজ্ঞ ও অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে এসবের সুবিধা পায়নি।