ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক ভারত ও চিনে ঔপনিবেশিক শােষণের আধিপত্যের বৈসাদৃশ্যগুলি উল্লেখ করাে।

ঔপনিবেশিক শোষণ বিষয়ে ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বৈসাদৃশ্য

ইউরােপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ভারত ও চিনে ব্যাপকভাবে ঔপনিবেশিক শােষণ চালায়। ঔপনিবেশিক শােষণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। তবে উভয় দেশের মধ্যে ঔপনিবেশিক শােষণের অভিজ্ঞতার বৈসাদৃশ্যও লক্ষণীয়। ভারত ও চিনের ঔপনিবেশিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্যগুলি সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল一


ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার বৈসাদৃশ্য


ভারত


  • সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে ইউরােপ থেকে ভারতে আসা বণিকদের বাণিজ্য করার বিষয়ে কখনও সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিল না। বিভিন্ন ইউরােপীয় শক্তি এদেশে বাণিজ্য কুঠি প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেয়েছিল। যাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল পাের্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিরা।


  • প্রথমদিকে পাের্তুগাল, ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি ইউরােপীয় রাষ্ট্র ভারতে বাণিজ্য কুঠি প্রতিষ্ঠা করে। শেষপর্যন্ত অন্যান্য শক্তিগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হারিয়ে ইংরেজরা এদেশে নিজেদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।


  • কোম্পানি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফারুখশিয়ারের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায়। এর ফলে তারা অন্যান্য ইউরােপীয় বণিক ও ভারতের দেশীয় বণিকদের চেয়ে অনেক বাড়তি সুবিধা পায়।


  • ব্রিটিশ কোম্পানি এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির (১৭৬৫ খ্রি.) দ্বারা মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ‘দেওয়ানি’ অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। এই রাজস্ব তারা ভারতে বাণিজ্যের পুঁজি হিসেবে বিনিয়ােগ করে।


  • পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের দ্বারা ইংরেজরা বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে তারা অযােধ্যা, মারাঠা, মহীশূর, পাঞ্জাব-সহ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধ ও সন্ধির মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভারত একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়।


  • ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায় আন্দোলন গড়ে তুললেও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস দল। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দল ভারতে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।


  • ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্বে গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়াে আন্দোলন, সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফোজের সংগ্রাম, নৌবিদ্রোহ প্রভৃতি ঘটনা ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে (১৫ আগস্ট) স্বাধীন ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটে।


চিন


  • অষ্টাদশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরােপ থেকে চিনে আসা বণিকদের বাণিজ্য একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। কোনাে বিদেশি দূত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চিন সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে চিন সম্রাটকে 'নজরানা' বা উপঢৌকন দিতে হত এবং 'কাও তাও' প্রথা অনুসারে সম্রাটের সামনে আভূমি মাথা নত করতে হত।


  • চিনে বিভিন্ন ইউরােপীয় শক্তির মধ্যে ইংরেজরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ঠিকই তবে অন্যান্য শক্তিগুলির আধিপত্য সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি। ব্রিটেনের পর চিনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল আমেরিকা। এ ছাড়া ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান, ওলন্দাজ প্রভৃতি শক্তিগুলিও চিনে কিছু না কিছু আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।


  • ইংরেজরা ভারতের মতাে চিনে 'দস্তক' বা বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার পায়নি। ফলে তারা চিনের বাণিজ্যে অন্যান্য বহিরাগত বণিক জাতির চেয়ে শুল্ক-সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা পায়নি।


  • ইংরেজ বা অন্যান্য ইউরােপীয় বণিক জাতিগুলি চিনে ‘দেওয়ানি’বারাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করতে পারেনি। ফলে এরা চিনে বাণিজ্য করার জন্য প্রয়ােজনীয় মূলধন নিজ নিজ দেশ থেকে আনতে বাধ্য হয়।


  • ইউরােপীয় শক্তিগুলি চিনের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। সমগ্র চিনের শাসন ক্ষমতা তারা দখল করতে পারেনি। আইনত রাজাই ছিলেন চিনের শাসক। তাই চিনকে বিদেশি শক্তিগুলির পূর্ণাঙ্গ উপনিবেশ না বলে 'আধা-উপনিবেশ' বলা যায়।


  • চিনে বিভিন্ন বিদেশি বণিক জাতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি চিনে আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।


  • ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের পর মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অনুগত চিনের কুয়ােমিনতাং দলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। শেষপর্যন্ত কুয়ােমিনতাং দল পরাজিত হয় এবং মাও সে তুং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে (১ অক্টোবর) গণ-প্রজাতান্ত্রিক চিনের প্রতিষ্ঠা করেন।