ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক ভারত ও চিনে ঔপনিবেশিক শােষণের অভিজ্ঞতার মধ্যে সাদৃশ্যগুলি উল্লেখ করাে।

ঔপনিবেশিক শােষণ বিষয়ে ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে সাদৃশ্য

ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী বণিক জাতি অষ্টাদশ শতকে এশিয়ার যেসব দেশে বাণিজি্যিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত ও চিন। বিদেশিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, যেমন一


ভারত ও চিনের অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য


ভারত


  • ইংরেজরা প্রথম ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব সিরাজ উদদৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।


  • ভারতে আসা ইউরােপীয় শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষপর্যন্ত ফরাসি শক্তিকে পরাজিত করে ব্রিটেন এদেশে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।


  • ইউরােপের শিল্পজাত পণ্যসামগ্রীতে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়। এই পণ্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় পিছু হঠে ভারতের শিল্প ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়।


  • বিদেশি শক্তিগুলি, বিশেষ করে ব্রিটেন ভারতবর্ষকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে।


  • ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে বহু চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক দীর্ঘকাল ধরে আফ্রিকা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও খনিজ উৎপাদনের কাজে পাঠাতে থাকে।


  • ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের ওপর চাপানাে কয়েকটি অসম চুক্তি হল—আলিনগরের সন্ধি, এলাহাবাদের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্ধি, ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি, সলবাইয়ের সন্ধি, বেসিনের সন্ধি প্রভৃতি।


  • ইংরেজ কোম্পানি ভারতের বৃহদংশে তীব্র শােষণমূলক ভূমিব্যবস্থা চালু করে। তা ছাড়া বিলাতি পণ্য ভারতের বাজারগুলি ছেয়ে গেলে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হয় এবং শিল্পী কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে।


  • ভারতের বাণিজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের দখলে চলে যায়। ফলে ভারতের দেশীয় বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


  • ভারতের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, কাঁচামাল ও বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত অর্থ দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে বিলাতে চলে যেতে থাকে। ফলে ভারতের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।


  • ভারতের শােষিত ও নির্যাতিত প্রজারা অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার, ভারতের জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বারংবার আন্দোলনে শামিল হয়।


চিন


  • ইংরেজরা প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধে (১৮৩৯-৪০ খ্রি.) চিনকে পরাজিত করে নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করার পর চিনে আধিপত্যের সূচনা করে।


  • চিনে বাণিজ্য করতে আসা বিদেশি শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষপর্যন্ত ব্রিটেন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।


  • বিদেশের কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্য চিনে আমদানি করা হত। এই পণ্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় চিনের শিল্প পিছিয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বণিকরা ভারত থেকে চিনে আফিম রপ্তানি করত।


  • বিদেশি শক্তিগুলি চিনকেও একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে।


  • ব্রিটিশরা ভারতের মতাে চিন থেকেও প্রচুর চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংগ্রহ করে আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অনুন্নত স্থানের কৃষি ও খনিজ উৎপাদনের কাজে পাঠায়।


  • ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চিনের ওপর চাপানাে কয়েকটি অসম চুক্তি হলনানকিং-এর সন্ধি, বগ-এর সন্ধি, টিয়েনসিনের সন্ধি, পিকিং-এর সন্ধি, শিমােনােসেকির সন্ধি প্রভৃতি।


  • চিনের বিভিন্ন বন্দর বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়লে সমগ্র চিন বিদেশি পণ্যে ছেয়ে যায়। দামে ও মানে বিদেশের যন্ত্রে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় চিনের কুটিরশিল্প ধ্বংস হয় এবং শিল্পী ও কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে।


  • বৈদেশিক শােষণে চিনের বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ, আমেরিকা ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের দখলে চলে যায়। ফলে চিনের দেশীয় বাণিজ্য ধ্বংস হয়।


  • বিদেশি বণিকরা চিনের বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল, অর্থ, খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ অবিরাম নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। ফলে ক্রমে চিনের অর্থনৈতিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায়।


  • চিনে বিদেশি বণিকদের শােষণ এবং মাণ্ডু রাজবংশের অপশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়।