চিনের ওপর আরােপিত 'অসম চুক্তি' বলতে কী বােঝায়? এই অসম চুক্তি বা বৈষম্যমূলক চুক্তির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।

চিনের ওপর আরােপিত অসম চুক্তি

একদা বিদেশিদের জন্য রুদ্ধ চিনের অভ্যন্তরে বিদেশিরা উনিশ শতক থেকে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং চিনের অভ্যন্তরে নিজেদের ক্ষমতার জাল ছড়িয়ে দেয়। বহিরাগত, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি মােটামুটিভাবে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত চিনে কিং বংশের শাসনকালে চিনকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে এবং যুদ্ধের পর চিনের ওপর বিভিন্ন শােষণমূলক সন্ধি বা চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে 'অসম চুক্তি' বা বৈষম্যমূলক চুক্তি (Unequal treaty) নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চিনা ঐতিহাসিক ওয়াং ডং-এর মতে, 'অসম চুক্তি' কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বহুল প্রচলিত হলেও এর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন অর্থের অভাব রয়েছে। তা ছাড়া সঠিক কোন্ চুক্তিগুলিকে বা কতগুলি চুক্তিকে 'অসম' বা ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দেওয়া উচিত তা-ও পরিষ্কার নয়। 


চিনের ওপর আরােপিত অসম চুক্তির বৈশিষ্ট্য


১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত চিনের ওপর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিভিন্ন 'অসম' বা ‘বৈষম্যমূলক’ চুক্তি সাক্ষরে বাধ্য করে। এই চুক্তিগুলিকে চিনের শতাব্দীব্যাপী অবমাননা (Century of Humiliation) বলে চিহ্নিত করা হয়। চিনের ওপর বিদেশিদের আরােপ করা বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যেমন一


[1] একতরফা চুক্তি: প্রতিটি চুক্তির ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কোনাে পশ্চিমি শক্তির কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তারা চিনের ওপর একতরফাভাবে এসব চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। চুক্তির শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে চিনের মতামতের কোনাে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।


[2] ভৌগোলিক আধিপত্য: চিনের ওপর বিভিন্ন অসম চুক্তি আরােপের মাধ্যমে বিদেশি শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের একাধিপত্য স্থাপন করে। এইসব অঞ্চলগুলিতে বিদেশি আইন ও প্রশাসন কার্যকরী হয়।


[3] সার্বভৌমত্ব সংকুচিত: চিনের ওপর আরােপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলি সরাসরি চিনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করে। এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে চিনের সার্বভৌম ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। চিন প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমি শক্তিগুলির আধা উপনিবেশ’-এ পরিণত হয়।


[4] খনিজ সম্পদ রপ্তানি: বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের ওপর অসম চুক্তিগুলি চাপিয়ে চিনের বিভিন্ন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে নেয়। এইসব সম্পদ চিনের বন্দরগুলি থেকে বিদেশে রপ্তানি হলে বিদেশের শিল্প ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটে। অন্যদিকে চিনের শিল্প ও অর্থনীতি ক্রমাগত ভেঙে পড়তে থাকে।


[5] ক্ষতিপূরণ দান: প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ও পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধগুলির জন্য চিনই একমাত্র দায়ী ছিল না। অথচ যুদ্ধের পর পশ্চিমি শক্তিগুলি বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে চিনের ওপর নানকিং-এর চুক্তির ন্যায় বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে চিনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে।


[6] বাণিজ্য করার অধিকার: বিভিন্ন অসম চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কাছে চিন তার বিভিন্ন বন্দর বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে ও বিভিন্ন ভূখণ্ড লিজ (lease) দিতে বাধ্য হয়। চিন তার হংকং বন্দর ব্রিটেনের জন্য এবং ম্যাকাও বন্দর পাের্তুগালের জন্য খুলে দেয়। বাণিজ্যিক সুযােগসুবিধা ছাড়াও চিন বিদেশির আরও বিভিন্ন রকম সুযােগসুবিধা দিতে বাধ্য হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিদেশি শক্তিগুলির দ্বারা চিনের ওপর আরােপিত এই চুক্তিগুলিকে 'অসম' বা 'বৈষম্যমূলক' বলে অভিহিত করা হয়।


[7] শুল্ক ছাড়: বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের ওপর ওয়াংঘিয়ার ন্যায় বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে নিজেদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় নিতে থাকে। চিনের বণিকরা সরকারকে ন্যায্য শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করলেও বিদেশিরা শুল্ক ছাড় পেয়ে বাণিজ্যে অধিক মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে চিনের দেশীয় বাণিজ্য মার খেতে থাকে।


রায়তওয়ারি ও মহলওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে যা জান লেখাে।


অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চিনে বিদেশিদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হত? কোন্ পরিস্থিতিতে চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে?


চিনের খনিজ সম্পদের ওপর বিদেশিদের আধিপত্যের প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।