১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।

সূচনা: নৌবিদ্রোহ ভারতবাসীর স্বাধীনতালাভকে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিল। কারণ এই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ দ্রুত ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।


নৌবিদ্রোহ (১৯৪৬ খ্রি.)

[1] বিদ্রোহের সূচনা: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাই বন্দরে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির 'তলােয়ার' জাহাজের রেডিয়াে অপারেটর বলাই দত্ত স্লোগান লেখেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ', 'British Quit India', 'বন্দেমাতরম', 'জয়হিন্দ' ইত্যাদি। এই অপরাধে নৌকর্তৃপক্ষ বলাই দত্তকে পদচ্যুত করে। এর প্রতিবাদে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান এম. এস. খানের নেতৃত্বে ১৫০০ নাবিক বিদ্রোহ ঘােষণা করে (১৮ ফেব্রুয়ারি)। বােম্বাইয়ের ২২টি জাহাজে এবং করাচির হিন্দুস্থান জাহাজে এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।


[2] নৌবিদ্রোহের কারণ


  • আই. এন. এ. সেনাদের বিচার: যুদ্ধবন্দি আইনে আই. এন. এ.- র তিন সেনাপতি গুরুদয়াল সিং ধিলন, প্রেম সেহগল, শাহনওয়াজ খানকে দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয় প্রকাশ্য বিচারের জন্য। ৫৭ দিন ধরে চলা এই মামলায় (৫ নভেম্বর-৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও আত্মত্যাগের কাহিনি প্রকাশিত হয়, যা নৌসেনাদের উদ্বুদ্ধ করে।


  • ব্রিটিশ কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার: নৌসেনাবাহিনীতে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নাবিকদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও খারাপ ব্যবহার করত।


  • বেতন বৈষম্য: সমযােগ্যতা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কখনােই ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হত না। একই কাজে এই ধরনের বৈষম্যে ভারতীয় নৌসেনাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।


  • নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ: বহুবার ভালাে খাবারের আবেদন করেও ভারতীয় নৌসেনারা তা পায়নি, ফলে তাদের মনে এক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল।


  • পদোন্নতির ও পুনর্বাসনের সুযােগ না থাকা: ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কোনােদিনই পদোন্নতি হত না। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না।


  • দক্ষিণ এশিয়ার মুক্তিসংগ্রাম: কাম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মায়ানমারে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলন গড়ে ওঠে ভারতীয় সেনাদের ওপরও তার প্রভাব পড়ে।


[3] নৌবিদ্রোহের প্রসার: তলােয়ার জাহাজের বিদ্রোহের পর শীঘ্রই বােম্বাইয়ের আরও ২২টি জাহাজে নাবিকরা বিদ্রোহ শুরু করে। ক্রমে করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজ, কোচিন, জামনগর, চট্টগ্রাম, বিশাখাপত্তনম, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। 'ইংরেজ ভারত ছাড়াে’ ধ্বনিতে বিদ্রোহীরা মুখরিত হয়। করাচিতে ব্রিটিশ জাহাজে অগ্নিসংযােগ করা হয়।


[4] স্ট্রাইক কমিটির দাবি: নৌ সংগ্রাম পরিচালনা ও বিভিন্ন বিদ্রোহী কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিদ্রোহীরা একজোট হয়ে নৌসেনা কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতি (Naval Central Strike Committee) গঠন করে (১৯ ফেব্রুয়ারি)। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন এম. এস. খান, ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন মদন সিং। স্ট্রাইক কমিটি বেশ কিছু দাবি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। এই দাবিগুলি হল-


  • [i] আই. এন. এ. সেনাদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান। 

  • [ii] তলোয়ার জাহাজের সেনাপ্রধান (কমান্ডার) এফ. ডব্লিউ. কিং-এর বিরুদ্ধে শাস্তিগ্রহণ। 

  • [iii] ভারতীয় নৌসেনাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। 

  • [iv] উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করা। 

  • [v] ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনা। 

  • [vi] ক্যান্টিনে ব্রিটিশ ও ভারতীয় নাবিকদের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানাে। 

  • [vii] নৌবাহিনী ছেড়ে যাওয়ার সময় পােশাক ফেরত না নেওয়া।


[5] আন্দোলনের অবসান: ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে নৌসেনাধ্যক্ষ অ্যাডমিরাল গডফ্রের নির্দেশে ডক অঞ্চলে বিমান থেকে গােলা বর্ষণ করা হয়। অবশেষে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে (২৩ ফেব্রুয়ারি)।


[6] নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব


  • আলাপ-আলােচনার ওপর গুরুত্ব: নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ব্রিটিশ এই প্রথম আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে গুরুত্ব আরােপ করে।


  • ব্রিটিশ ভীতির অবসানে: নৌসেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি দূর করেছিল। দেশীয় সেনা ও সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়েছিল।


  • হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনে: হিন্দু মুসলিম নাবিক, এমনকি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম প্রজারাও বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল।


উপসংহার: নৌবিদ্রোহের জন্যই ব্রিটিশ প্রশাসন শীঘ্রই ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল।


আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানের বর্ণনা দাও।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভূমিকার মূল্যায়ন করাে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণগুলি লেখাে।


আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া আলােচনা করাে। রশিদ আলি দিবস কেন পালিত হয়?