আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া আলােচনা করাে | রশিদ আলি দিবস কেন পালিত হয়?

সূচনা: ভারতের বাইরে থেকে মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে ভারতবাসীর স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে এগিয়ে আনতে পেরেছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর নির্ভিক সেনারা। তাই এই দেশপ্রেমিক যােদ্ধাদের বন্দি করে বিচার শুরু হলে ভারতবাসী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে।


আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচার ও ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া

[1] বিচার শুরু: ৫ নভেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার শুরু হয়। ২০ হাজার বন্দি আজাদ হিন্দ সেনার মধ্যে প্রকাশ্যে মাত্র কয়েকশাে জনের বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে তিন সেনাপতির প্রথম (শাহনওয়াজ খান, পি. কে. সেহেগল, জি. এস. ধিলন) বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাদের একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও অন্যজন শিখ। এইভাবে বেছে বেছে তিন ধর্মের তিনজন মানুষের বিচারের প্রহসনে হিন্দু মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে গােটা ভারত গর্জে ওঠে।


[2] আজাদ হিন্দ সেনাদের সমর্থনে সর্বস্তরের মানুষ: এই বিচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পােস্টার- পত্রপত্রিকা-পুস্তিকা, সভাসমিতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে খেটেখাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তশালী ভারতীয় পর্যন্ত ব্রিটিশবিরােধী প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে। জাতিধর্মবর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে সারা ভারতের মানুষই এই আন্দোলনে শামিল হয়।


  • কংগ্রেস আইনজীবীদের সমর্থন: আজাদ হিন্দ সেনাদের পক্ষে আইনজ্ঞ হিসেবে এগিয়ে আসেন ভুলাভাই দেশাই, জওহরলাল নেহরু, অরুণা আসফ আলি, তেজবাহাদুর সপ্ত, কৈলাসনাথ কাটজু প্রমুখের মতাে কংগ্রেসের প্রথম সারির আইন বিশেষজ্ঞ। জওহরলাল নেহরু দীর্ঘ ২৫ বছর পর নিজের গায়ে তুলে নেন আইনজীবীর পােশাক।


  • ভারতীয় সেনাদের সমর্থন: শুধু সাধারণ মানুষই নন, ব্রিটিশের সামরিক উর্দি পরা ভারতীয় সেনারা পর্যন্ত সামরিক শৃঙ্খলাকে লঙ্ঘন করে আজাদ হিন্দ বন্দিদের সমর্থনে ডাকা সভায় দলে দলে যােগ দিতে শুরু করে। কলকাতা, এলাহাবাদ, কানপুরের বিমানবাহিনীর কর্মচারীরা আজাদ হিন্দ সেনার সমর্থনে অর্থ সংগ্রহেও নামে। কেবল পদাতিক নয়, সেনাবাহিনীর তিনটি শাখাতেই এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।


[3] বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ: কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, অকালি দল, শিখ লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ইউনিয়নিস্ট পার্টি, জাস্টিস পার্টি প্রভৃতি সমস্ত রাজনৈতিক দল মতপার্থক্য ভুলে আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে সােচ্চার হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ভাইসরয় ওয়াভেল লিখেছেন সমস্ত রাজনৈতিক দল একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। তবে সবার চেয়ে বেশি সােচ্চার কংগ্রেস। দেশের বিভিন্ন পৌরসভা, জেলাবাের্ড, প্রবাসী ভারতীয়, বিভিন্ন গুরুদ্বার কমিটি, বােম্বাই ও কলকাতার চিত্রতারকারা এমনকী বােম্বাই ও অমরাবতীর টাঙ্গাওয়ালারাও অর্থ সাহায্য করে।


[4] গণবিক্ষোভ: জাতিধর্মবর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারের সাহায্যের জন্য দেশের নানাস্থান থেকে আর্থিক সাহায্য আসতে থাকে। দেশজুড়ে পালিত হয় 'আজাদ হিন্দ দিবস' ও 'আজাদ হিন্দ সপ্তাহ''জয়হিন্দ', 'আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তি চাই’, 'লালকেল্লা ভেঙে ফ্যালাে' ইত্যাদি নানা ধ্বনিতে ভারত মুখরিত হয়ে ওঠে। ছােটোবড়াে অসংখ্য মিছিল ও সভাসমিতি দেশজুড়ে সংগঠিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড়াে সভাটি আয়ােজিত হয় দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে। কয়েক লক্ষ মানুষের ওই সমাবেশে ভাষণ দেন নেতাজি অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল।


[5] কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন: কলকাতার আন্দোলনই ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল। এখানে আন্দোলনে ছাত্ররা খুবই উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ২১ নভেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ছাত্র ব্লক (ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন), ছাত্র ফেডারেশন (কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন) এবং ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ)-সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করে। তারা ডালহৌসি স্কোয়ারে ঢুকতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ক্যালকাটা টেকনিকাল স্কুলের ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জি এবং শ্রমিক আবদুস সালাম মারা যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের দু-দিন কলকাতা জুড়ে চলে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। ট্রাম, বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি, রিকশা-সহ বাজারহাট, স্কুলকলেজ, কলকারখানা সব কিছু বন্ধ থাকে।


রশিদ আলি দিবস


১ ডিসেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে) সরকার ঘােষণা করে যে, হত্যা ও নৃশংস ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ছাড়া সব বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু পরের বছর ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপটেন রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপটেন রশিদ আলিকে বিচারে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্যাপক ছাত্রধর্মঘট, ১২ তারিখে রশিদ আলি দিবস পালিত হয় এবং সাধারণ ধর্মঘট কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলকে অচল করে দেয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এক বিশাল সমাবেশে লিগ, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট নেতারা বক্তব্য রাখার পর ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে মিছিল এগিয়ে গেলে কলকাতার অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী কলকাতার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেয়। ওই ক-দিনের সংঘর্ষে সরকারি হিসেবে ৮৪ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়। কিশােরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতার এই গণ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই সেদিন লিখেছিলেন, "বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারই দিন পঞ্জিকা লিখে।"


উপসংহার: এই আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতায় বিস্মিত ব্রিটিশ সরকার শেষপর্যন্ত আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার বাতিল করতে বাধ্য হয়। অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন—“মৃত (?) সুভাষ, জীবিত সুভাষের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়েছিলেন।”