গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে | ভারতের গণপরিষদের প্রকৃতি আলােচনা করাে।

গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী ভারতীয়দের দীর্ঘকালের দাবি ছিল যে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয়দের নিয়ে একটি গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠন করতে হবে। সেই দাবি অনুসারে স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদ গঠিত হয়।


[1] সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে 'লাহাের প্রস্তাব' গ্রহণ করে এবং এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথক পাকিস্তান আদায়ের দাবিতে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে মুসলিম জনমত গড়ে তােলা শুরু হয়। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান দাবিকে সামনে রেখে লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ও লিগ নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য পায়।


[2] অন্তর্বর্তী মন্ত্রীসভা: মন্ত্রী মিশনের (১৯৪৬ খ্রি.) প্রস্তাব অনুসারে কেন্দ্রে একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ছিল। লিগ এই অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ না দিয়ে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে সােচ্চার হয়। এই পরিস্থিতিতে বড়ােলাট লর্ড ওয়াভেল ১২ আগস্ট (১৯৪৬ খ্রি.) কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানালে জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে।


[3] লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম: ওয়াভেল কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুকে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানালে মুসলিম লিগ সরকারের বিরুদ্ধে 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামের' (Direct Action) ডাক দেয়। সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিলেও কার্যত তা হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। বাংলার লিগ সরকারের প্রত্যক্ষ প্ররােচনায় পুলিশ ও প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রেখে কলকাতায় পাঁচদিন ধরে (১৬-২০ আগস্ট) ব্যাপক দাঙ্গা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা 'কলকাতা হত্যাকাণ্ড' (Great Calcutta Killing) নামে পরিচিত। ইংরেজ ঐতিহাসিক মােসলে লিখেছেন যে, "এই ক-দিনে কলকাতার ছ-হাজার লােক ছােরা, বন্দুক, লাঠি বা অগ্নিদাহে নিহত হয় এবং বিশ হাজার নারী ধর্ষিতা ও বিকলাঙ্গ হয়।"


[4] দাঙ্গার বিস্তার: কলকাতার দাঙ্গার রক্তের দাগ শুকোতে নাশুকোতেই বােম্বাই (১ সেপ্টেম্বর), নােয়াখালি ও ত্রিপুরা (১০ অক্টোবর), বিহার (২৫ অক্টোবর), যুক্তপ্রদেশের গড়মুক্তেশ্বর (নভেম্বর), পাঞ্জাব (মার্চ, ১৯৪৭ খ্রি.) প্রভৃতি স্থানে দ্রুত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। 


  • [i] নােয়াখালি ও ত্রিপুরার দাঙ্গা বীভৎস আকার ধারণ করে। স্টেটসম্যান পত্রিকার মতে, এই দাঙ্গার প্রধান লক্ষ্য ছিল লুটপাট এবং মানুষকে ধর্মান্তরিত করা। 

  • [ii] নােয়াখালির দাঙ্গার বদলা হিসেবে বিহারে হিন্দুরা দাঙ্গা শুরু করে প্রচুর মুসলিমকে হত্যা করে। 

  • [iii] বিহারের পর গড়মুক্তেশ্বরে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা প্রায় ১ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। 

  • [iv] পাঞ্জাবের লাহাের, অমৃতসর, মূলতান, আটক, রাওয়ালপিণ্ডি প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক নরহত্যা ও অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটে।


[5] অন্তর্বর্তী সরকার গঠন: হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেই বড়ােলাট লর্ড ওয়াভেলের আহ্বানে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লিগ প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ না দিলেও কংগ্রেসের ক্ষমতা বিপুল বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় লিগে ৫ জন সদস্য ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীসভায় যােগ দেয়। তবে তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারি কাজে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা এবং এর দ্বারা সরকারকে অচল করে দিয়ে ভারত বিভাগকে অনিবার্য করে তােলা। গান্ধিজির জীবনীকার ও ব্যক্তিগত সচিব প্যারেলাল বলেন, "যেদিন মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগদান করল সেদিনই অখণ্ড ভারত গঠনের লড়াই চিরতরে পরাজিত হল।"


[6] গণপরিষদ গঠন: অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রাদেশিক আইনসভার বিধায়কদের ভােটদানের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং গণপরিষদ গঠিত হয়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৯ ডিসেম্বর (১৯৪৬ খ্রি.) দিল্লিতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসলে লিগ এই অধিবেশনে যােগ না দিয়ে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে জোর প্রচার চালাতে থাকে এবং গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়।


গণপরিষদের প্রকৃতি


নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত যে সংস্থাটি দেশের সংবিধান রচনা করে তা হল গণপরিষদ। গণপরিষদে একদলীয়, দক্ষিণপন্থী, পুঁজিবাদী শ্রেণির প্রতিনিধিবর্গেরও সমাবেশ ঘটেছিল। প্রাদেশিক আইনসভাগুলির বিধায়কগণ গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট থেকে গণপরিষদ সার্বভৌম পরিষদের মর্যাদা লাভ করে। গণপরিষদের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়


[1] প্রকৃতি


  • জনপ্রতিনিধিত্বহীন: ভারতীয় গণপরিষদকে কোনােভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ বলা চলে না। কেন-না সদস্যগণ ভারতীয়দের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদের সদস্যগণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত হননি। তাই প্রকৃতিগত বিচারে গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন এক পরিষদ।


  • আইনবিদদের প্রাধান্য: গণপরিষদ ছিল আইনবিদদের প্রাধান্যবিশিষ্ট এক পরিষদ। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মূলত যে ২১জন সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার মধ্যে ১১ জনই ছিলেন বিশিষ্ট আইনবিদ। এই আইনবিদগণ সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন ধারা-উপধারাগুলির বিচার বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আইভর জেনিংস তাই গণপরিষদকে 'আইনজীবীদের স্বর্গ' বলে উল্লেখ করেছেন।


  • একদলীয়: সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না থাকায় ভারতীয় গণপরিষদ সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। দেশবিভাগের ফলে লিগের সদস্যরা পাকিস্তানে চলে গেলে ভারতীয় গণপরিষদ সম্পূর্ণরূপে একটি একদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়। সােমনাথ লাহিড়ি কমিউনিস্ট দলের তরফে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও দেশবিভাগজনিত কারণে তাকে সদস্যপদ হারাতে হয়।


[2] আপসমুখী: ভারতীয় গণপরিষদ ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের আপসরফার ফল। গণপরিষদে দেশীয় রাজন্যবর্গের তরফে যােগদানকারী প্রতিনিধিবর্গ সর্বদা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়াস চালান। দেশীয় রাজন্যবর্গের স্বার্থ রক্ষার ফলশ্রুতি হিসেবে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করা হয়। যেমন—দেশীয় রাজন্যবর্গকে ভাতা, খেতাব, উপাধি প্রভৃতি দান তারই নিদর্শন।


[3] অগণতান্ত্রিক: দেশীয় রাজন্যবর্গকে গণপরিষদে ৯৩ জন সদস্য মনােনয়নের ক্ষমতা দেওয়ার ফলে গণপরিষদ তার গণতান্ত্রিক প্রকৃতি হারায়। এ প্রসঙ্গে দামােদর স্বরূপ শেঠ সমালােচনার সুরে বলেছেন দেশবাসীর শতকরা ১৪ ভাগ কর্তৃক পরােক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ কখনােই সকল দেশবাসীর হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।