মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা কী ছিল | এই মিশনের ত্রূটি ও গুরুত্ব লেখাে।

মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা বা সুপারিশ বা প্রস্তাবসমূহ

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলির পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভারতে আসে। ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, নৌবাহিনীর প্রধান এ.ভি. আলেকজান্ডার ও বাণিজ্য বাের্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এই তিনজন সদস্যকে নিয়ে প্রতিনিধিদল গঠিত হয়। এটি মন্ত্রী বা ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন তার নিজস্ব সুপারিশ ঘােষণা করে। এই সুপারিশে বলা হয়一


[1] যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতবর্ষে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Federal Union) গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি পরবর্তীকালে এই যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দিতে পারবে।


[2] ক্ষমতা বণ্টন: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হবে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যােগাযােগের দায়িত্ব পাবে কেন্দ্র এবং অন্যান্য বিষয় থাকবে প্রদেশের হাতে।


[3] প্রদেশ গঠন: ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হবে—

  • [i] হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছয়টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে প্রথম অঞ্চল, 

  • [ii] মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে দ্বিতীয় অঞ্চল এবং 

  • [iii] বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হবে তৃতীয় অঞ্চল।


[4] গণপরিষদ গঠন: প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে।


[5] যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের অধিকার: নতুন সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের পর কোনাে রাজ্য ইচ্ছা করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারবে।


[6] অন্তর্বর্তী সরকার: নতুন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার শাসন লিনা করবে।


মন্ত্রী মিশনের ত্রূটি


[1] ভারত বিভাজনের পথ প্রস্তুত: মন্ত্রী মিশন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব রাখেন। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে। প্রদেশগুলিকে হিন্দু প্রধান ও মুসলিম প্রধান— এই দু-ভাগে ভাগ করার উল্লেখ থাকায় পরােক্ষভাবে ভারত বিভাজনের পথই প্রস্তুত হয়।


[2] দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে: মন্ত্রী মিশন প্রদেশগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যােগাযােগ ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের রূপরেখা ফুটে ওঠে।


মন্ত্রী মিশনের গুরুত্ব


১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।


[1] অবিভক্ত রাখার প্রয়াস: মিশন স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিল যে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়া—এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের শেষ আন্তরিক প্রয়াস।


[2] প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার: এই প্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।


[3] অসাম্প্রদায়িক শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ: এতদিন শাসনতান্ত্রিক আলােচনার ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতার সৃষ্টি হত। এর থেকে মুক্তি পেতে মন্ত্রী মিশন হিন্দু, মুসলিম ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনাে সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি না দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।


[4] অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণ: গণপরিষদে কোনাে অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণের প্রস্তাব ছিল না।


[5] গণপরিষদের ক্ষমতা: ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।