বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে আলােচনা করাে | বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল লেখাে।

সূচনা: মিরকাশিম অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলা এবং মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজবাহিনীর বক্সারের প্রান্তরে যে যুদ্ধ বাঁধে তা বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত।


বক্সারের যুদ্ধের কারণ

[1] মিরকাশিমের স্বাধীনচেতা মনােভাব: মিরকাশিম আলি খান পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তােলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি আর্থিক ও সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এ ছাড়াও ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি মুরশিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) রাজধানী স্থানান্তর করেন। তার এই উদ্যোগ ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করে।


[2] আর্থিক পদক্ষেপ: একজন স্বাধীন নবাবের মতােই মিরকাশিম আর্থিক সংস্কারের দ্বারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তিনি—


  • [i] জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা বাড়ান। 

  • [ii] ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন—এমন কর্মচারী ও জমিদারদেরও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশােধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন। 

  • [iii] রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন। 

  • [iv] আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।


[3] সামরিক উদ্যোগ: মিরকাশিম এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ইউরােপীয় রণকৌশল গ্রহণের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগান, তাতার পারসিক এবং আর্মেনীয়দের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরি (গুরগিন খাঁ)-কে তিনি তার প্রধান সেনাপতি ও ওলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করেন। ফরাসি সমরু (ওয়াল্টার রাইন হাউন্ড)-কে ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি অন্য সমর বিভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও আর্মেনীয় কারিগরদের সাহায্য নিয়ে তিনি মুঙ্গেরে কামান ও বন্দুক তৈরির এক অস্ত্রকারখানা নির্মাণ করেন। মিরকাশিমের এই সামরিক উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে।


[4] শুল্ক বিবাদ: কোম্পানির কর্মচারীরা যথেচ্ছভাবে ব্যক্তিগত বাণিজ্য দস্তক বা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিতে শুরু করে। পরিণামে দেশীয় বণিকগােষ্ঠীর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নবাবও তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। মিরকাশিম এই সংকটমােচনের জন্য ভ্যান্সিটার্ট-এর কাছে এক আবেদন জানান। কিন্তু তাতেও সংকটের নিরসন না হওয়ায় মিরকাশিম দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেন। ফলে কোম্পানিকে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযােগিতামূলক বাণিজ্যের মুখােমুখি হতে হয়। এতে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ফলে ইংরেজ ও কোম্পানি, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সংঘটিত হয় বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর)। মিরকাশিমের সেনাপতি মার্কার ও ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মনরাের কাছে পরাজিত (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর) হলে, ব্রিটিশ শক্তি সুদৃঢ় হয়।


বক্সারে যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব


[1] ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ হিসেবে: বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যদি ইংরেজদের প্রতিকূলে যেত তাহলে ভারতের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত।


[2] ঔপনিবেশিক শাসনের দৃঢ়তায়: পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনকে দঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।


[3] বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়: বক্সারের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাব মিরকাশিমের পরাজয় ঘটায় ব্রিটিশ শক্তিকে বাধা দেওয়ার মতাে আর কোনাে শাসক রইল না, ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ নিস্কণ্টক হল।


[4] উত্তর ভারতে আধিপত্য সূচনায়: বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়। অযােধ্যায় নবাব সুজা-উদদৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মােগল বাদশা কোম্পানির দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে কোম্পানির আধিপত্যের সূচনা ঘটে।


[4] আর্থিক লুণ্ঠনের সূচনায়: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদদৌলার কাছ থেকে পনেরাে লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলার কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।


[5] দেওয়ানি লাভের ক্ষেত্রে: বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বহুগুণ বেড়েছিল।


উপসংহার: বক্সারের যুদ্ধের পরেই বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল। বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর থেকেই ভারতের ইতিহাসে প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়।


ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে বাংলায় দেওয়ানি লাভ করে? দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব বা ফলাফলগুলি আলােচনা করাে।


ভারতবর্ষে আধিপত্য লাভের ক্ষেত্রে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।


পলাশির যুদ্ধ সম্পর্কে আলােচনা করাে। অথবা, পলাশির যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল লেখাে।