ভারতবর্ষে আধিপত্য লাভের ক্ষেত্রে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

সূচনা: ভারতে নিজেদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য গড়ে তােলার ক্ষেত্রে ইংরেজ ও ফরাসি শক্তি পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এই দ্বন্দ্ব ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত। এই দ্বন্দ্বের পরিণতি প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮ খ্রি.), দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৯-৫৪ খ্রি.) এবং তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩ খ্রি.)।


ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব


প্রেক্ষাপট


  • অসম বাণিজ্য: ভারত আগত ইউরােপীয় বণিক কোম্পানিগুলির মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল অধিক শক্তিশালী। প্রথম দিকে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের মধ্যে বাণিজ্যিক সমতা বজায় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ফরাসি বণিকরা বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজ বণিকদের তুলনায় পিছিয়ে পড়লে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে পড়ে।


  • রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রচেষ্টা: বাংলায় ব্রিটিশ এবং দাক্ষিণাত্যে ফরাসিরা রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য গড়ে তােলার উদ্যোগ নেয়। বাংলা ছাড়িয়ে কর্ণাটকের রাজনীতিতেও ব্রিটিশরা হস্তক্ষেপ করতে গেলে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব বাঁধে।


  • অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ: অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়াকে ও ফ্রান্স প্রাশিয়াকে সমর্থন করে। ইউরােপের রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে কর্ণাটকের ইংরেজ ও ফরাসিরা। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।


ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের বিবরণ


  • প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর হায়দ্রাবাদ মােগল অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। আইনত কর্ণাটক হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীনে থাকলেও নবাব দোস্ত আলি স্বাধীনভাবেই রাজ্যশাসন করতেন। দোস্ত আলির মৃত্যুর পর নিজাম মনােনীত আনােয়ারউদ্দিন কর্ণাটকের নবাব হন। এদিকে কর্ণাটকের সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার চাঁদসাহেব (দোস্ত আলির জামাতা) সিংহাসন পদ থেকে বঞ্চিত হলে তাঁর অনুগামীরা ক্ষুধ হয়। আনােয়ারউদ্দিনের শাসনাধীন মাদ্রাজে ইংরেজরা বাণিজ্যকেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। ইউরােপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ নৌসেনাপতি কমডাের বার্নেট কিছু ফরাসি যুদ্ধজাহাজ দখল করে নেয়। ডুপ্লের আবেদনে সাড়া দিয়ে মরিশাসের ফরাসি গভর্নর লা বুরদনে আটটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সসৈন্যে হাজির হলে ইংরেজরা মাদ্রাজ ত্যাগ করে। মাদ্রাজ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইংরেজরা আনােয়ারউদ্দিনের শরণাপন্ন হয়। ডুপ্লের চালাকিতে ক্ষুব্ধ হয়ে আনােয়ারউদ্দিন ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। মাইলাপুর বা সেন্টথােমের এই যুদ্ধে (১৭৪৬ খ্রি.) নবাব পরাজিত হন। অবশেষে আই-লা-স্যাপােলর সন্ধির দ্বারা ইউরােপে উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান ঘটলে পুনরায় ইংরেজরা মাদ্রাজ ফিরে পায়। অবসান ঘটে প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধের।


  • দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ: হায়দ্রাবাদের নবাব নিজাম উল মুলুক মারা গেলে নবাব পদ নিয়ে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নাসির জঙ্গ ও দৌহিত্র মুজাফফর জঙ্গের মধ্যে বিরােধ বাঁধে। এই বিরােধে ডুপ্লে মুজাফফর জঙ্গকে সমর্থন জানান। অপরদিকে, কর্ণাটকের নবাব পদ নিয়ে আনােয়ারউদ্দিন ও চাদাসাহেবের বিবাদে ডুপ্লে চাঁদসাহেবকে সমর্থন করেন। দাক্ষিণাত্যে একক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভের লক্ষ্যে ডুপ্লে চাঁদ সাহেব ও মুজাফফর জঙ্গের সঙ্গে একজোট হন। এই জোটের কাছে অম্বুরের যুদ্ধে (১৭৪৯ খ্রি.) আনােয়ারউদ্দিন পরাজিত ও নিহত হন। ডুপ্লের মদতে চাঁদসাহেব কর্ণাটকের নবাব হলে ইংরেজ শক্তি উদবিগ্ন হয়ে ওঠে। তারা নাসির জঙ্গকে (নিজামের পুত্র) হায়দ্রাবাদের এবং মহম্মদ আলি (আনােয়ারউদ্দিনের পুত্র)-কে কর্ণাটকের সিংহাসনে বসানাের উদ্যোগ নেয়। ফলে ইঙ্গ-ফরাসিদের মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৯ খ্রি.)। অবশেষে এক সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে (১৭৫৫ খ্রি.) ইংরেজ ও ফরাসি একে অপরের অধিকার করা অঞ্চলগুলি ফেরত দিলে দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের অবসান ঘটে।


  • তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ: ইউরােপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ বাঁধে। নৌসেনার প্রধান পােপক এর নেতৃত্বে ইংরেজরা বাংলার ফরাসি ঘাঁটি চন্দননগর দখল করে (১৭৫৭ খ্রি.)। বন্দিবাসের যুদ্ধে (১৭৬০ খ্রি.) ব্রিটিশ সেনাপতি আয়ারকূট ফরাসি সেনাপতি কাউন্ট ডি লালিকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। পণ্ডিচেরি, মাহে ও জিঞ্জি ফরাসিদের হস্তচ্যুত হয়। অবশেষে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে (১৭৬৩ খ্রি.) ইউরােপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটলে ভারতে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব সমাপ্ত হয়।


ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের ফলাফল


  • নতুন সমরকৌশলের প্রবর্তন: কর্ণাটকের যুদ্ধে শেষপর্যন্ত পরাজয়ের ফলে ভারতে নতুন সমরনীতি ও যুদ্ধকৌশলের প্রবর্তন হয়। পাশাপাশি ইংরেজরা এটা বুঝতে পারে যে, ভারতীয় সৈন্যদের ইউরােপীয় পদ্ধতিতে শিক্ষা দিলে তারা ইউরােপীয় সৈন্যের সমকক্ষ হতে পারে।


  • ইংরেজ কোম্পানির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা: কর্ণাটকের যুদ্ধে শেষপর্যন্ত পরাজয়ের ফলে ভারতে ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের আশা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এমনকি এদেশে তাদের বাণিজ্য বিস্তারের সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যায়। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে এদেশে ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়।


  • ভারতীয় অন্ত ও বহির্বাণিজ্যে প্রাধান্য: কর্ণাটকের যুদ্ধে শেষপর্যন্ত ইংরেজ শক্তি বিজয়ী হয়ে ভারতের বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে তাদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে। এতে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলার নবাবের সঙ্গে কোম্পানির তীব্র বিরােধ দেখা দেয়।


উপসংহার: কর্ণাটক যুদ্ধে শেষপর্যন্ত ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলে এদেশে তাদের রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়।


ব্রিটিশ শাসনকালে দেশীয় উদ্যোগে শিল্পের বিকাশের বিবরণ দাও।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি ও ফলাফল আলােচনা করাে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি লেখাে।


ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে বাংলায় দেওয়ানি লাভ করে? দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব বা ফলাফলগুলি আলােচনা করাে।