সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?

বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার

[1] কৌলীন্য প্রথার বিরােধিতা: তৎকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথার ফলে কুল রক্ষার উদ্দেশ্যে বহু পিতামাতা তাদের বালিকা কন্যাকে খুব বয়স্ক, এমনকি বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দিতেন। এর ফলে ভবিষ্যতে হিন্দু নারীর জীবনে সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসত। তিনি এই কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কৌলীন্য প্রথার সুযােগ নিয়ে কুলীন ব্রাক্ষ্মণরা কীভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে তা তিনি হুগলি জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে প্রমাণ দেন।


[2] বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে উদ্যোগ: বিধবা নারীদের জীবনের করুণ দশা বিদ্যাসাগরকে খুবই ব্যথিত করে। তিনি হিন্দুশাস্ত্র বিশেষত 'পরাশর সংহিতা' থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তিনি বিধবাবিবাহের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন এবং আন্দোলন গড়ে তােলেন। তা ছাড়া দরিদ্র বিধবাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে 'হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড' গঠন করেন।


[3] বিধবাবিবাহ আইন পাস: বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুটি পুস্তিকা রচনা করেন। এক বছরের মধ্যেই পুস্তিকা দুটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তার উদ্যোগে বিধবাবিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর ১ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে। পাঠানাে হয়। শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (২৬ জুলাই) ১৪০ নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন।


[4] বিধবাবিবাহের আয়ােজন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (৭ ডিসেম্বর) বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহয়ানন্দ মুখােপাধ্যায়ের ১০ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতী দেবীকে বিবাহ করেন। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে অষ্টাদশী বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিজের উদ্যোগে ৮২ টাকা ব্যয় করে ৬০ জন বিধবার বিবাহ দেন।


[5] বাল্যবিবাহের বিরােধিতা: উনবিংশ শতকে ভারতের হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহের প্রকোপ ছিল। বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর সর্বশুভকরী সভার মুখপাত্র সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সােমপ্রকাশ পত্রিকায় লেখা হয়— বাল্যবিধবাদের দুঃখ মােচনের জন্যই বিধবাবিবাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জোরালাে প্রচার ও সােচ্চার প্রতিবাদ শুরু করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১০ বছর ধার্য করে দেয়।


[6] বহুবিবাহের বিরােধিতা: বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোেলন। তিনি বর্ধমানের মহারাজার সহায়তায় বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে ৫০ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। বহুবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর-সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর সরকার হিন্দুদের সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বহুবিবাহ বন্ধের বিষয়টি আর বেশি দূর এগােয়নি। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন (১৮৭১ খ্রি.) এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়। তাঁর প্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়।


[7] অন্যান্য সংস্কার: বিদ্যাসাগর তৎকালীন বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, কুষ্ঠরােগী হত্যা, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সােচ্চার প্রতিবাদ করেন।


মূল্যায়ন: উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.)।